২০১৩ সালের ৩০ মে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ঋতুপর্ণ ঘোষ চলে যান
২০১৩ সালের ৩০ মে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ঋতুপর্ণ ঘোষ চলে যান

একজন ঝিনুক

‘ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও, ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!’ এটা আমাদের কবি আবুল হাসানের পঙ্‌ক্তি। ভারতের যে চলচ্চিত্রকারকে আজ স্মরণ করব, তিনিও বোধকরি আমাদেরই। আমাদের ভাষাতেই তো তিনি সিনেমা বানিয়েছেন, আমাদের রবীন্দ্রনাথকেই তিনি যাপন করেছেন। আর নিজের যন্ত্রণাগুলোকে মুক্তায় রূপান্তর করে সেসবও আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন মূলত একজন ঝিনুক, ঋতুপর্ণ ঘোষ।

ঋতুপর্ণ ঘোষ
ঋতুপর্ণের ছবির এক ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল। অ্যাকশন-টেনশন-সেক্স আর ভায়োলেন্সের বদলে মানুষের ভেতর জগতের গল্প পর্দায় দেখাতে ভালোবাসতেন তিনি। ছবির গল্পে মাথার ভেতরে চেপে বসে থাকা গোঁড়া সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন।

মনে পড়ে, তখন আমাদের শৈশবকাল। তাপস পাল, প্রসেনজিৎদের সিনেমা দেখতেন মা-খালা-মামিরা। সংখ্যা ও বয়সে কম বলে আমরাও দেখতাম তাঁদের রুচির সিনেমা, যেগুলোর গল্প প্রায় একই রকম। বহুকাল পর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ওই যে ছবিগুলো আপনি করতেন, সেসব থেকে বের হলেন কীভাবে?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘বেরোতে হয়েছে। নয়তো দর্শক ছুড়ে ফেলে দিত।’ তারও অনেক পরে জানতে পারলাম, প্রসেনজিতের নেপথ্যে যে মানুষটি তাঁকে পরামর্শ দিতেন, তিনি ঋতুপর্ণ। দুজন ছিলেন বন্ধুর চেয়ে বেশি।

ছবির সেটে ঋতুপর্ণ: ঋতুপর্ণ নিজের মতো করে গড়ে-পিটে সিনেমার একটি ধরন দাঁড় করিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে প্রথম প্রসেনজিৎ কাজ করেন ‘উনিশে এপ্রিল’ ছবিতে। ছোট্ট এক চরিত্র, কিন্তু সেটা থেকেই যেন বড় একটা ঘটনার সূত্রপাত হয়। জন্ম হয় অন্য রকম এক অভিনেতা প্রসেনজিতের। পরে ঋতুর একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়—‘উৎসব’, ‘চোখের বালি’, ‘দোসর’,‘দ্য লাস্ট লিয়ার’, ‘খেলা’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ ও ‘নৌকাডুবি’।

ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে প্রথম প্রসেনজিৎ কাজ করেন ‘উনিশে এপ্রিল’ ছবিতে

বন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রসেনজিৎ একবার বলেছিলেন, ‘তত দিনে আমি একাধিক বাণিজ্যিক ছবি করে ফেলেছি। কিন্তু আমার মধ্যে যে একজন অভিনেতা আছে, সেটা বুঝতে পেরেছিল ঋতু। গৎবাঁধা নাচ-গান আর মারপিটের বাইরেও যে আমি অন্য ধাঁচের চরিত্রে অভিনয় করতে পারি, সেটা তো আমি নিজেই জানতাম না। প্রত্যেক অভিনেতাই যেন একজন পরিচালকের খোঁজে থাকেন, যিনি তাঁকে ভেঙেচুরে গড়ে ওঠার সাহস দেবেন, দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ দেবেন। আমার জীবনে ঋতু ছিল সেই পরিচালক।’ এই হচ্ছে অভিনেতা বের করে আনা ঋতুপর্ণর নেপথ্য–কথা।

আমার মধ্যে যে একজন অভিনেতা আছে, সেটা বুঝতে পেরেছিল ঋতু। গৎবাঁধা নাচ-গান আর মারপিটের বাইরেও যে আমি অন্য ধাঁচের চরিত্রে অভিনয় করতে পারি, সেটা তো আমি নিজেই জানতাম না। প্রত্যেক অভিনেতাই যেন একজন পরিচালকের খোঁজে থাকেন, যিনি তাঁকে ভেঙেচুরে গড়ে ওঠার সাহস দেবেন, দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ দেবেন। আমার জীবনে ঋতু ছিল সেই পরিচালক।
প্রসেনজিৎ

ঋতুপর্ণের ছবির এক ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল। অ্যাকশন-টেনশন-সেক্স আর ভায়োলেন্সের বদলে মানুষের ভেতর জগতের গল্প পর্দায় দেখাতে ভালোবাসতেন তিনি। ছবির গল্পে মাথার ভেতরে চেপে বসে থাকা গোঁড়া সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন। অগ্রসর দর্শককে দিতেন ভাবনার খোরাক আর সাধারণকে দিতেন দম ফেলার সুযোগ। রাজনৈতিক চেতনা তাঁর ভেতরে প্রবল ছিল বলে ছবিতে সেসব নানাভাবে বার্তা হিসেবে হাজির হতো। লেখাতেও তিনি আক্ষেপ করেছেন নিজ ভূমির রাজনৈতিক অবক্ষয় নিয়ে।

ঋতু জন্মেছিলেন পুরুষের দেহে। হৃদয়টা তা মানেনি। এ যন্ত্রণাই তাঁকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। নানা সংস্কার, কুসংস্কার, প্রথা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ে জর্জরিত শিল্পীর জীবনের আরেক যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটি। এ রকম যন্ত্রণাই হয়তো তাঁকে এমন বহুগুণের আধার করেছিল। কেবল নির্মাণ বা লেখালেখি নয়, অভিনয় বা নৃত্য নয়, স্পষ্টভাষী মানুষ হিসেবে তিনি বহুবার বহু প্রগতিশীলকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন।

ঋতুপর্ণ ঘোষ

শরীরটাকে মনের সঙ্গে মেলাতে একদিন তিনি চিকিৎসকের হাতে নিজেকে তুলে দিয়েছিলেন। সেটা অবশ্য তাঁকে খানিক শান্তি দিয়েছিল। কিন্তু শরীর সায় দেয়নি। অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। আগে থেকেই ছিল অনিদ্রা। ১০ বছর ভুগেছেন ডায়াবেটিস এবং পাঁচ বছর অগ্ন্যাশয়ের রোগে। ২০১৩ সালের ৩০ মে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তিনি চলে যান।

ঋতুপর্ণের জন্ম ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায়। মা–বাবা দুজনই চলচ্চিত্রজগতের মানুষ ছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন নব্বইয়ের দশকে, তথ্যচিত্র দিয়ে। ঋতুপর্ণ ঘোষ ছোটদের জন্য লেখা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প থেকে প্রথম তৈরি করেন কাহিনিচিত্র ‘হীরের আংটি’, যেটি মুক্তি পায় ১৯৯২ সালে। এরপর ১৯৯৪ সালে ‘উনিশে এপ্রিল’। এ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।

এরপর একে একে ‘শুভ মহরত’ (২০০৩), ‘রেইনকোট’ (২০০৪), ‘অন্তরমহল’ (২০০৫), ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ (২০০৭), ‘খেলা’ (২০০৮), ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৮), ‘আবহমান’ (২০০৯), ‘নৌকাডুবি’ (২০১০), ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ (২০১১), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (২০১২), ‘জীবনস্মৃতি’ (২০১২) ছবিগুলো পরিচালনার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রভাবশালী নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অমিতাভ বচ্চন, মনীষা কৈরালা, ঐশ্বরিয়া রায় বচ্চন, জ্যাকি শ্রফ, সোহা আলী খান, রাখি গুলজার, রাইমা সেন, রিয়া সেন, শর্মিলা ঠাকুর, নন্দিতা দাস, প্রীতি জিনতা, অর্জুন রামপাল, যীশু সেনগুপ্ত, দীপংকর দে ও মমতা শঙ্করের মতো শিল্পীরা এসব ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

ঋতুপর্ণের জন্ম ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায়

সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক কুমার ঘটকের হাত ধরে যে ধারার চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়, বলা চলে ঋতু তারই ধারক ছিলেন। পরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন ও গৌতম ঘোষ নিজেদের মতো করে সেটা এগিয়ে নিয়েছেন। সে রকমটা এখন আর তেমন দেখা যায় না। হয়তো ঋতুপর্ণের মতো অতটা যন্ত্রণা এখন আর কারও নেই যে ঝিনুক ঋতুর মতো মুক্তো ফলাবে!