ইরফান খানের সঙ্গে সেবার নতুন করে পরিচয় হলো নেমসেক (২০০৬) চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। এমন নয় তাঁকে কখনো সামনাসামনি দেখেছি। এমনও নয় তিনি আমাকে চেনেন বা চেনার ন্যূনতম সম্ভাবনা ছিল। তবে অবাক করা বিষয় দেশ, ভাষা, মাধ্যম আলাদা হওয়া সত্ত্বেও কখনো তাঁকে দূরবর্তী বলে মনে হয়নি আমার। ইরফান বলতেন, এখানেই শিল্পের মজা। আপনার ছোট্ট একটা কাজ মানুষের মনে এমন আঁক কষে যে আপনাকে সে মনে রাখে যুগ যুগ ধরে।
এ শহরে (ঢাকায়) যখন তিনি এসেছিলেন, তখনো তাঁকে সামনাসামনি দেখার আকাঙ্ক্ষা আমার তৈরি হয়নি। অথচ মিডিয়ার শিক্ষার্থী এই আমাকে, ইরফান ভাবাচ্ছেন অনেক দিন থেকেই। খুব সাধারণের মধ্য দিয়ে অনন্যসাধারণ বলেই তাঁর প্রতি আমার বাড়তি আকর্ষণ। আর তাই এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন, আর তার জন্মদিনে, তাঁকে নিয়েই এলিজি লিখতে বসতে হবে, তা আমার ভাবনার অতীত ছিল।
যা–ই হোক, ২০০৬–এ মুক্তি পাওয়া নেমসেক দেখেছিলাম ২০১২ তে, ভারতে বসেই, সে দেশের বন্ধু-সহপাঠী ঋতুপর্ণা ব্যানার্জির পরামর্শে।
নেমসেক দেখার বাড়তি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল মিরা নায়ারের পরিচালনা আর ঝুম্পা লাহিড়ীর উপন্যাসের এডাপ্টেশন বলে, কিন্তু আরও মুগ্ধ হয়ে শেষ করলাম ইরফান খানের অভিনয় দেখে।
সে বছরই মুক্তি পেল ‘লাইফ অব পাই’। হলে গিয়ে দেখলাম সে ছবি, ভারতেই। মুগ্ধ হলাম। শুধু সিনেমা দেখেই নয় বরং অল্প সময়ের সাদামাটা উপস্থিতিতে ইরফানের অনন্যতা দেখে। চলচ্চিত্রটিতে টাকার বড় অংশ লগ্নি হয়েছিল কোনো গ্ল্যামার নয়, নাচ নয়, গান নয়, শুধু অভিনেতাদের দক্ষতা আর ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের ওপরে আর প্রথম সপ্তাহের শেষে ছবিটির আয় দাঁড়িয়েছিল ১৯.৫ কোটি রুপি। ইরফান কিন্তু টাকার মাপকাঠিতে মাপতে চাননি কোনো চলচ্চিত্র আর অভিনেতাকে। এ ধরনের মাপকাঠিকে তিনি বাজে প্রবণতা মনে করতেন। অর্থ আর জনপ্রিয়তাকে তিনি বলতেন অভিনয়ের ‘বাইপ্রডাক্ট’।
বলিউডের মূল স্রোত থেকে গা বাঁচিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে এমন সম্মান এবং তারই পথ ধরে জনপ্রিয়তা ইরফানই প্রথম অর্জন করেছিলেন। নিয়ম ভেঙে নিজের মতো করে নিয়ম গড়া ইরফানের প্রিয় কাজ ছিল।
২০১৭ সালে সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপমা চোপড়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গতানুগতিক কোনো সিস্টেমেই ‘ফিট’ হতে পারেন না তিনি। ‘বোরড’ হয়ে যান। তাই ‘পরম্পরা’ বা ‘ট্রাডিশন’ ভাঙটাই তাঁর জন্মগত অভ্যাস ছিল বলেও জানিয়েছিলেন।
শিল্পির কর্মে তাঁর ব্যক্তি জীবনের ছাপ রয়ে যায়। শিল্প এমন এক পরিসর, যেখানে নিজেকে আড়াল করার উপায় থাকে না। তাই চলচ্চিত্রে চরিত্র বাছাইয়ের বৈচিত্র্য, অনন্যতা তাঁর যাপিত জীবনেও দেখতে পাই। সামন্ততান্ত্রিক পরিবারে জন্ম। বাবা ছিলেন শিকারি, তাই বাবার হাত ধরেই শিকারে হাতেখড়ি তাঁর। কিন্তু শিকারের ভয়াবহতা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। স্কুলে চুপচাপ থাকতেন বলে, তাঁকে নিয়ে মজাও করত সবাই।
বলিউডের মূল স্রোত থেকে গা বাঁচিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে এমন সম্মান এবং তারই পথ ধরে জনপ্রিয়তা ইরফানই প্রথম অর্জন করেছিলেন। নিয়ম ভেঙে নিজের মতো করে নিয়ম গড়া ইরফানের প্রিয় কাজ ছিল।
দাদার সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক ছিল না বলে থাকতে হতো এমন এক বাসায়, যেখানে ছাদের রেলিং ছিল খুবই নিচু। সেখান থেকে পড়ে গিয়ে বাঁ হাত ভেঙে যাওয়া, যা শেষের দিকেও তাঁকে ভুগিয়েছে। কিন্তু সামনে এগোনোর গতি থামাননি তিনি। অবশেষে বাড়ির নিয়ম ভেঙে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে (এনএসডি) পড়ার সুযোগ পেয়ে জয়পুর থেকে পাড়ি জমান দিল্লির উদ্দেশে। এখান থেকেই তাঁর নবজন্মের শুরু।
টিভি সিরিয়াল করেছেন। সেখানে পাওয়া পারিশ্রমিকের টাকায় ভিসিআর কিনে চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন। বই পড়তেন দিন–রাত। ঘরের বাইরে অথবা লিফটের ভেতরেও জোরে জোরে আওড়াতেন ডায়ালগ। লোকজন তাকিয়ে থাকত। বলতেন, জন্মসূত্রে অভিনয়ের গুণ আসেনি আমার মধ্যে, তাই অভিনয়কে প্রতিমুহূর্তে ‘আবাদ’ করতে হয়েছে নিজের ভেতরে।
চ্যালেঞ্জিং অভিনয়ের কথা বললে বলেন, ‘লাইফ অব পাই’ (২০১২)–এর কথা। ছবিতে ইংলিশ একসেন্ট–এর ভেরিয়েশনের কথা। বলেছিলেন এইচবিও চ্যানেলের জন্য সিরিজ, ইন ট্রিটমেন্ট (২০০৮)–এর কথাও। অন্য রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন ‘পান সিং টুমারে’ (২০১২) কাজ করে। কারণ, ‘পান সিং টুমারে’ অভিনয়ের সময় তিনি অনেকবার আহত হয়েছেন। চলচ্চিত্রটি ভারতে মুক্তি পেয়েছিলও তৈরি হওয়ার অনেক পরে, প্রায় কোনো ধরনের প্রচারণা ছাড়াই। অথচ ছবিটি হিট হয়েছিল।
যাপিত জীবন নিয়ে তাঁর বোধ অনেকের থেকেই আলাদা। নারীকে কীভাবে বোঝা যায়, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, প্রতিটি মানুষের মাঝে নারী-পুরুষ দুই–ই বিরাজ করে। নিজের মাঝের নারীকে বুঝতে পারলেই নারীকে চেনা যাবে। ইন্ডিয়া টিভির কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলিউডে ইংরেজির দৌরাত্ম নিয়ে বলেছিলেন, একটি ভাষা আপনাকে এলিট বানাতে পারে না। বরং আপনার ভেতরে কী আছে, সেটাই আপনাকে আলাদা করে তোলে। এর প্রতিফলনও দেখতে পাই তাঁর অভিনীত হিন্দি মিডিয়াম (২০১৭) ও ‘আংরেজি মিডিয়াম’ (২০২০) চলচ্চিত্রে। একজন ইংরেজি না জানা ভদ্রলোকের ইংরেজি শিখে নিয়ে বিশ্বজয়ের গল্প নয় এটা, বরং নিজ পরিসরে নিজ ভাষায় আনন্দে থাকার গল্প ছিল চলচ্চিত্র দুটিতে।
ইরফান বলেছিলেন বর্তমান চলচ্চিত্রের গানগুলো আসলে চলচ্চিত্রের জন্য বোঝা। ফর্মুলার বাইরে নতুন কিছু করতে ভয় পান বর্তমান নির্মাতারা, এমন কথাও বলেছিলেন কঙ্গনা রনৌতের সঙ্গে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত আইটেম বা পার্টি গানগুলোর ভেতরের অসারতা নিয়ে স্যাটায়ার করে ইউটিউব চ্যানেল এআইবি–এর সঙ্গে তৈরি করেছেন ভিডিও ‘পাটি সং’।
দেখিয়েছেন চলচ্চিত্র বিক্রি-বাট্টার জন্য মেধা আর গল্পকে দূরে সরিয়ে কীভাবে গেড়ে বসেছে অশ্লীলতা আর চটুল কনটেন্ট।
তার পুরো নাম সাহেবজাদে ইরফান আলী খান। পরে চলচ্চিত্র শুরু করেন ইরফান খান নামে। অনেকেই তাঁকে সেরা খান বলছেন। অথচ শেষের দিকে নিজের নাম থেকে খান নামটি বিযুক্ত করেছিলেন তিনি। বলতেন ধর্ম আমার আর ইশ্বরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, এটাকে প্রকাশ্যে জানানোর প্রয়োজন কী? আরও বলেছিলেন, বংশ নয় বরং নিজ পরিচয়ে পরিচিত হতেই ভালো লাগে তাঁর। তাই এই বিযুক্তিকরণ। ভারতীয় মিডিয়া যখন ইরফানকে ‘নিউ কিং খান’ আখ্যা দিচ্ছে, এমন সময় নাম থেকে খান বিযুক্তিকরণ দেখে মনে হতে থাকে, বলিউডে অজস্র ‘খান’ (আমির, শাহরুখ, সালমান, সাইফ) দের ভিড়ে, আরেকজন ‘খান’ হিসেবে স্টার হওয়ার ইঁদুর দৌড়কে প্রত্যাখ্যানই করেছিলেন হয়তোবা।
এখানে এসেই ইরফান আবার বিকল্প পথ বেঁছে নেন, যেমন নিয়েছিলেন জনপ্রিয় হওয়ার অনেক অনেক দিন আগেও।
কোনো নির্দিষ্ট ইমেজে নিজেকে বেঁধে ফেলতে নারাজ ছিলেন তিনি। তাই বলিউডের নির্দিষ্ট ইমেজকেন্দ্রিক অভিনয়ই (চকলেট বয়, ড্রিম গার্ল) সফল হওয়ার একমাত্র উপায়, এমন ফর্মুলার বাইরে এসে নিজেকে গড়ে তুলছিলেন ক্রমাগত। ‘হাসিল’ (২০০৩) চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার অর্জন এবং ‘মকবুলে’ (২০০৩) সবার দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার পরও তিনি তাঁর খলনায়ক ইমেজ ভেঙে নতুনভাবে গড়ে তোলায় মনোযোগী হন। কারণ, অভিনয় করে যাওয়াটাই ছিল তাঁর মূলমন্ত্র, স্টার হওয়া নয়। আর তাই ‘স্লাম ডগ মিলিওনিয়ার’ (২০০৮), ‘পিকু’ (২০১৫), ‘জজবা’ (২০১৫), ‘ইনফারনো’ (২০১৬), ‘মাদারি’ (২০১৬), ‘পাজল’ (২০১৮) সহ তাঁর বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র আর অভিনয় বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছেন।
লন্ডন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের সময় ২০১৩ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন হলিউড, বলিউড, টলিউড কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিকেন্দ্রিক নয়, বরং তিনি পৃথিবীর সব দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে আগ্রহী।
বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ যেখানেই পাবেন, সেখানেই কাজ করবেন। এ জন্যই হয়তোবা ক্রিস্টোফার নোলানের, ব্লকবাস্টার হিট চলচ্চিত্র ইন্টারস্টেলার (২০১৪)–এ অভিনয়ের প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র লাঞ্চ বক্স (২০১৩) ও ডি-ডে (২০১৩) তে অভিনয়ের জন্য। ইন্টারস্টেলারে পরবর্তী সময়ে সেই চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন ম্যাট ডেমন। স্টিফেন স্পিলবার্গ–এর ছবিতে স্কারলেট জোহানসনের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ারের সুযোগ অনায়াসে না করেছেন, কারণ হিসেবে বলেছিলেন, অভিনয়ের যথেষ্ট সুযোগ নেই চরিত্রটিতে। অথচ না বলেননি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে। অভিনয় এবং আংশিক প্রযোজনা করেছেন ফারুকীর নির্মিত ‘ডুব’ (২০১৭) চলচ্চিত্রটিতে। কারণ, পরিচালকের নির্মিত ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ (২০১৩) দেখে তিনি পছন্দ করেছিলেন।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন হলিউড, বলিউড, টলিউড কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিকেন্দ্রিক নয়, বরং তিনি পৃথিবীর সব দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে আগ্রহী।
শেষে এসে আবার নেমসেক–এর কথা বলতে ইচ্ছা করছে। অনুপম খেরের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইরফান বলেছিলেন, তাঁর পরিবারে চলচ্চিত্র দেখার চল ছিল না। বলা যেতে পারে নিষিদ্ধই ছিল। কিন্তু ‘নেমসেক’ চলচ্চিত্রটি ইরফানের মা সাঈদা বেগম দেখেছিলেন। ছবি শেষে ইরফানকে আলাদা ডেকে বলেছিলেন, তিনি চলচ্চিত্রের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে চান। ইরফান অবাক। কেন দেখা করতে চান জানতে চাইলে সাঈদা বলেন, ছবির মধ্যে মেরে ফেলার জন্য আমার ছেলেকেই তাঁর বাছতে হলো? বিষয়টা তার মোটেও ভালো লাগেনি। সেই মায়ের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে, অজানায় পাড়ি জমিয়েছিলেন ইরফান। এপারে শেষ দেখা হয়নি, হয়তো ওপারে হয়েছে। ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের তারা হয়ে ওঠা ইরফান হঠাৎই কোনো সুযোগ না দিয়েই আকাশের তারা হয়ে গেলেন।
শুভ জন্মদিন ইরফান। ওপারে ভালো থাকবেন।
লেখক: শিক্ষক ও চলচ্চিত্র গবেষক।