বলিউড তারকা হৃতিক রোশন। ছোটবেলায় ছিলেন প্রচণ্ড রকমের লাজুক আর একগুঁয়ে। একা সময় কাটাতে পছন্দ করতেন, মেতে থাকতেন নিজস্ব এক জগৎ নিয়ে। বাছা বাছা কয়েকজন বন্ধু ছিল তাঁর। এমনকি বয়সে দুবছরের বড় বোনের বান্ধবীদের সঙ্গেও কথা বলতে লজ্জা পেতেন তিনি। চাপা স্বভাবের হলেও তাঁর স্বচ্ছ চোখের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যেত তাঁর অনুভবের ব্যাপ্তি! খুব ছোট ছোট প্রাপ্তি নিয়েই অনেক বেশি সুখের মাঝে ডুবে থাকতেন ছোট্ট হৃতিক!
হৃতিক রোশনের জীবনে তিনজন সুপারউইম্যান আছেন—মা, দিদি আর স্ত্রী। হৃতিকের ভাষ্যমতে, এঁদের জন্যই তিনি আজ ভক্তদের কাছে প্রিয় মুখ। হৃতিকের দিদি, সুনাইনা গতকাল শনিবার তাঁর ব্যক্তিগত ব্লগে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো শৈশবের দিনগুলো স্মৃতিচারণা করেছেন। ভাইবোনের নিখাদ ভালোবাসা আর শান্ত, আত্মপ্রত্যয়ী ছোট্ট হৃতিকের অনেক অজানা কথা পাঠকের জানার সৌভাগ্য হয়েছে। দিদির লেখার মাধ্যমে হৃতিককে অন্যভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পাবে পাঠক।
হৃতিকের তোতলামির স্বভাব ছিল কৈশোর পর্যন্ত। সুনাইনা এভাবে স্মরণ করছিলেন, ‘আমার মনে আছে, হৃতিকের যখন ১৩ বছর বয়স, সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক নাগাড়ে চিৎকার করে পড়ত। কি সকাল, কি রাত! সময়ে-অসময়ে, সারা দিন বাথরুমে, নিজের ঘরে সে নিজের কথা রেকর্ড করত, তারপর নিজেই বারবার শুনে দেখত, কোথায় ভুল হচ্ছে। বারবার অনুশীলন করত। ঠিক না হওয়া পর্যন্ত সে নড়ত না কিছুতেই।’
অভিনয়জগতে আসার অনেক আগে থেকেই হৃতিককে পাড়ি দিতে হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি, বেশির ভাগই তাঁর নিজের সঙ্গে নিজেরই যুদ্ধ! আর হৃতিক এসব বাঁধা অতিক্রম করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন মনগড়া পথ। সুনাইনার লেখা থেকে স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে সেসব কথা। আত্মনির্ভরশীল ছোট্ট হৃতিক নিজেকেই নিজে শেখাত। কখনো বিজ্ঞান, কখনো বিভিন্ন ধরনের বই ঘাঁটাঘাঁটি করা, কখনো অনুশীলন, ধীরে ধীরে এসবের সাহায্যেই নিজে নিজে সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতেন তিনি।
অদ্ভুত প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক কিশোরের এ পরীক্ষা দিয়ে আসতে হয়েছে বারবার। একবার তাঁর মেরুদণ্ডে খিঁচুনির মতো রোগ ধরা পড়ে। ডাক্তার বললেন, এটি জিনগত সমস্যা। শৈশব থেকে নৃত্যের প্রতি অদম্য ঝোঁক ছিল যাঁর, তাঁর নাকি নাচ বন্ধ করে দিতে হবে! ডাক্তার কড়া করে বারণ করলেন, অভিনেতা ও নৃত্যশিল্পী হওয়ার ইচ্ছে যেন এখুনি বাদ দেন তিনি, নতুবা যেকোনো সময় হুইলচেয়ারে স্থায়ীভাবে বসতে হবে তাঁকে। হৃতিক নিজের তাগিদে এরপর অনেক ডাক্তারের কাছে যান। একসময় আত্মবিশ্বাসের কাছে জয়ী হন, ছুটতে থাকেন নিজের লক্ষ্যের দিকে।
ছোটবেলা থেকেই হৃতিকের নাচের প্রতি অনেক আগ্রহ। মাইকেল জ্যাকসনের খুব ভক্ত ছিলেন। তবে পরিবার বা কাছের বন্ধুদের সামনে কিছুতেই নাচতেন না, একা একা চর্চা করতেন নৃত্যকৌশল। হৃতিক যখন অনার্স শেষ করেন, তাঁদের বাবা তখন বাইরে পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন, সেই সময় হৃতিক দৃঢ়চিত্তে বাবাকে জানান, তিনি এবার ক্যামেরার মুখোমুখি হতে চান।
অভিনয়জগতে তখন হৃতিকের বিচরণ শুরু হয়েছে। এরই মাঝে একদিন ডাক্তারের প্রতিবেদনে ধরা পড়ে, হৃতিকের মস্তিষ্কে ছোট্ট পিণ্ডের মতো কী যেন আছে! তাঁর পরিবার দিশেহারা হয়ে দিনের মাঝে তিন-চারজন ডাক্তারের কাছে ছুটছে তখন। সুনাইনার মেঘে ঢাকা স্মৃতিময় লেখায় সেসব দিনের ব্যথা ফুটে ওঠে, ‘এই খবর শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য একদম নিথর হয়ে যাই। কেমন করে আমি আমার ছোট্ট ভাইটাকে এই অসহ্য যন্ত্রণা বহন করতে দেখব? সেই শক্তি আমাকে কে দেবে!’
সুনাইনার কাছে তাঁর ভাই, ‘হৃতিক’ নয়, ‘ডুজ্ঞু’। আদরের ছোট ভাই ডুজ্ঞু। এই শিরোনামেই ব্লগটি লিখেছেন তিনি। লেখার শুরুতেই সহজ স্বীকারোক্তি করেন, ডুজ্ঞু দুই বছরের ছোট হলেও সব সময় দিদিকে আগলে রেখেছেন বড় ভাইয়ের মতো। সুনাইনা বলেন, ‘ডাক্তারের কাছে এই ভয়ংকর রোগের কথা শুনেও হৃতিক ওর স্বভাবসুলভ আচরণে শান্ত ও স্থির ছিল। যখনই যে ডাক্তারের কাছে আমরা ছুটে গেছি, হৃতিক একটা কথাই সবাইকে জিজ্ঞেস করছিল, তাকে সুস্থ হওয়ার জন্য কতখানি সময় ধরে চিকিৎসা চলবে? কারণ, তাকে খুব দ্রুত শুটিং স্পটে ফিরতে হবে।’
সুনাইনা তাঁর লেখা এভাবেই শেষ করেন, ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার সবটুকু মায়া ছড়িয়ে দিয়ে, ‘ডুজ্ঞু, তুই আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম উপহার, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তুই। আমার জীবনের অর্থে একটা সুবর্ণরেখার মতো তুই আমাকে ঘিরে আছিস। আমি তোকে অতীতে ভালোবেসেছি, বর্তমানেও বাসি, আর ভবিষ্যতেও তোকে একইভাবে ভালোবাসব।’
দিদির এমন মায়াবী লেখা পড়ে বলিউড তারকা হৃতিক রোশনের মনে ঠিক কতখানি অশ্রু মেঘ এলোমেলো হয়ে ঘুরছিল, সে হিসাব কষার সাধ্য নেই। শুধু প্রকাশ্য অনুভূতিটুকুকেই পুঁজি করে বলা যায়, তিনি বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন। ব্লগটি শেয়ার করেন তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে। সঙ্গে লাজুক, স্বল্পভাষী ছোট্ট হৃতিকের অনুভবের মতনই ছোট্ট একটা শিরোলিপি, ‘আমার মিষ্টি বোন আমাকে স্মৃতির সড়কে নিয়ে গেছে। তোমাকেও ভালোবাসি, দিদি!’