তিনি হতে পারতেন ‘রং দে বাসন্তী’র অজয় রাঠোরের মতো পাইলট কিংবা ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর ফারহান কুরেশির মতো আলোকচিত্রী। সিনেমার জগতে আসার আগে কিশোর বয়সে এগুলোর ওপর প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। কিন্তু কানাডায় থাকাকালে কলেজের গ্র্যাজুয়েশন ইয়ারবুকে ‘অ্যাম্বিশন’-এর ঘরে মজার ছলে যা লিখেছিলেন, কে জানত, ভাগ্য সেখানেই নিয়ে যাবে আর মাধবনকে।
সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তা, মোটিভেশনাল স্পিকার, আলোকচিত্রী, ব্যবসাসহ নানা পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল তাঁর। এগুলোর কোনো পথেই বেশি দিন না হেঁটে শখের বশে মডেল হতে দাঁড়ান ক্যামেরার সামনে। সে পথই তাঁকে টেনে নিয়ে এল রুপালি পর্দার দুনিয়ায়। কিন্তু বাস্তব জীবনে পাশ কাটিয়ে আসা সম্ভাব্য পেশাগুলোর চরিত্রেই তাঁকে হাজির হতে হলো সিনেমার পর্দায়।
এ জন্যই হয়তো কলেজের ইয়ারবুকের একটি ছবি প্রায় তিন বছর আগে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে বলেছিলেন, ‘মহাবৈশ্বিক ষড়যন্ত্র’। ইয়ারবুকে অ্যাম্বিশনের ঘরে কিশোর মাধবন লিখেছিলেন, ‘টু বিকাম আ রিচ অ্যান্ড ফেমাস অ্যাক্টর অ্যান্ড বি আ জ্যাক অব অল ট্রেডস অ্যান্ড মাস্টার অব সাম।’
এখন পর্যন্ত ৫৭টি সিনেমায় অভিনয় করা আর মাধবন আসলেই ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস’। ইংরেজিসহ ভারতেরই অন্তত সাতটি আঞ্চলিক ভাষায় অভিনয় করেছেন। জয় করেছেন নিউজিল্যান্ডের অন্যতম সুউচ্চ ‘কুক’ পর্বতচূড়া। সুবক্তা। শখের বশে করেন মোটরসাইকেল রেসিং। খেলেন গলফও। বলে রাখা ভালো, এমন বাবার ছেলেও কম যায়নি। মাধবনের ছেলে বেদান্ত ২০১৯ সালের বয়সভিত্তিক এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে জিতেছেন ব্রোঞ্জ পদক।
সচ্ছল এক পরিবারে জন্ম রঙ্গনাথন মাধবনের। ১৯৭০ সালে বিহারের জামশেদপুরের (বর্তমান ঝাড়খন্ড) এক তামিলভাষী পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। বাবা ছিলেন টাটা স্টিলের ব্যবস্থাপনা নির্বাহী আর মা ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপক। ১৯৮৮ সালে মহারাষ্ট্রের কোলাহপুরে রাজারাম কলেজে পড়ার সময় ভারতের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে যান কানাডার আলবার্টায়। ২২ বছর বয়সে মহারাষ্ট্রের সেরা সাতজন এনসিসি ক্যাডেটের একজন ছিলেন মাধবন। এর সুবাদে সুযোগ পান ব্রিটিশ আর্মি, রয়্যাল নেভি ও রয়্যাল এয়ারফোর্স থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার। দেশে ফিরে মুম্বাইয়ের কিষিনচান্দ চেল্লারাম কলেজে স্নাতকোত্তর করার সময় পাবলিক স্পিকিং প্রতিযোগিতায় হন ভারতসেরা।
১৯৯২ সালে জাপানের টোকিওতে হওয়া ইয়ং বিজনেসম্যান কনফারেন্সের ভারতের প্রতিনিধিত্বও করেন। মুম্বাইয়ে থাকার সময়ই নিজের পোর্টফোলিও জমা দেন একটি মডেলিং এজেন্সিতে। করপোরেট দুনিয়ায় সম্ভাবনাময়ী এক তরুণের রুপালি পর্দায় আসার প্রথম ধাপটি শুরু হলো তখন থেকেই।
বেশ কিছু হিন্দি ভাষার বিজ্ঞাপন আর টিভি শোতে কাজ করেন শুরুতে। তবে বড় পর্দায় হাজির হন ইংরেজি ভাষার সিনেমা দিয়ে। আমেরিকান পরিচালক ফ্রেড ওলেন রে-এর অ্যাকশন ধাঁচের ছবি ‘ইনফার্নো’-তে (১৯৯৭) অভিনয় করেন পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্রে। পরে তামিল ইন্ডাস্ট্রির বিখ্যাত পরিচালক মনি রত্নমের নজরে পড়েন। ২০০০ সালে মুক্তি পায় ‘আলায় পায়ুথে’। এই ছবিতে মাধবন হাজির হন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে। পরে করেন আরও দুটি রোমান্টিক ঘরানার ছবি ‘মিন্নালে’ আর ‘মাদ্রাজ টকিজ’।
২০০১ সালে মুক্তি পায় মাধবনের প্রথম হিন্দি ভাষার সিনেমা ‘রেহনা হ্যায় তেরে দিল মে’। প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার চল তখন বেশ জনপ্রিয়। আর ছবিটির ‘থিম সং’ এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে দীর্ঘদিন মুঠোফোনের রিংটোন হিসেবেও ব্যবহার হয়। গত ২০ অক্টোবর ছিল সিনেমাটি মুক্তির ১৯ বছর। হিন্দি সিনেমাতে আর মাধবন উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিলেন ‘রং দে বাসন্তী’, ‘তনু ওয়েডস মনু’ কিংবা ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিতে।
২০০০ থেকে ২০১৫। এই সময়ে মাধবনের অভিনয় করা বেশির ভাগ সিনেমাই রোমান্টিক অথবা কমেডি ঘরানার। কিন্তু দর্শক খোঁজেন বৈচিত্র্য। একই ধাঁচের অভিনয়ে দর্শক যখন তাঁকে ‘চকলেট হিরো’র তালিকায় ফেললেন, তখনই চোখ খুলে যায় মাধবনের।
‘মাস্টার অব সাম’ হওয়ার যে কথা কলেজের ইয়ারবুকে লিখেছিলেন, তারই যাত্রা শুরু হলো ‘বিক্রম বেদ’ (২০১৭) দিয়ে। বিজয় সেথুপাতির সঙ্গে অ্যাকশন-থ্রিলার ধাঁচের এই সিনেমা যেন পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব মাধবনকে নতুন করে চেনাল।
যাঁরা সিনেমাটি দেখেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন অন্য মাধবনের খবর। না দেখে থাকলে নতুন মাধবনকে চিনতে দেখে ফেলুন ছবিটি। আর নীরবে ‘মাস্টার’ অভিনেতা হতে চলা মাধবনের সবশেষ মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘সাইলেন্স’ও দেখতে ভুলবেন না যেন।