খ্যাতনামা গায়ক তথা সংগীত পরিচালক বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুতে শোকাহত জনপ্রিয় গায়িকা ঊষা উথুপ। তিনি প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধিকে জানালেন প্রিয় বাপ্পিদার সঙ্গে তাঁর নানান স্মৃতি। একটু আনমনা হয়ে এই গায়িকা বলেন, ডিসকো কিং বাপ্পিদার যা সম্মান পাওয়া উচিত ছিল, তা তিনি পাননি। অথচ তিনি এই সম্মানের প্রকৃত দাবিদার ছিলেন।
বাপ্পিদা ছাড়া অসম্পূর্ণ আমি
বাপ্পিদা গায়ক হিসেবে দুর্দান্ত ছিলেন। তিনি ট্রেন্ড সেটার ছিলেন। বাপ্পিদা সব সময় ব্যতিক্রম কিছু করায় বিশ্বাস রাখতেন। আর তাই কোনো সিনেমা ফ্লপ হলেও তাঁর গান হিট হয়ে যেত। বাপ্পিদার সঙ্গে আমি অসংখ্য হিট গান উপহার দিয়েছি। দাদার মৃত্যুর খবর আমাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে আমার নিজের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। বাপ্পিদার গান ছাড়া আমার কোনো শো সম্পূর্ণ হতে পারে না। ‘কোই ইহাঁ’, ‘হরি ওম হরি’, ‘রামবা হো হো’—এসব গান ছাড়া আজও কোনো আসর জমে না। গত ৪০ বছরে একটা অনুষ্ঠানও আমি বাপ্পিদার গানগুলো ছাড়া করিনি। তাই বাপ্পিদা ছাড়া অসম্পূর্ণ আমি।
নতুনত্বে বিশ্বাসী
বাপ্পিদার গান রেকর্ড করার প্রক্রিয়া খুবই সাধারণ ছিল। আমরা প্রথমে গানের মহড়া করতাম। তারপর তিনি আমাদের রেকর্ডিংয়ের দিন জানাতেন। সেদিন আমরা জমিয়ে রেকর্ডিং করতাম। ‘রামবা হো হো’ গানে ‘হো’ শব্দটা রিপিট করার চিন্তাভাবনা তাঁরই ছিল। আর তাই গানটা আরও বেশি হিট হয়। কোনো গান তিনি সবিস্তার বুঝিয়ে দিতেন। বাপ্পিদা নতুনত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি সব সময় নতুন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মেতে থাকতেন। নতুন নতুন প্রতিভাকে সুযোগ দিতে বাপ্পিদা ভালোবাসতেন। তাঁর মতে, নতুন গায়ক মানেই নতুন গায়কি। দক্ষিণের খ্যাতনামা গায়িকা এস জানকি আম্মাকে দিয়ে তিনি ‘দিল মে হো তুম’, ‘ইয়ার বিনা চ্যায়েন কহাঁ রে’ গান দুটি গাইয়েছিলেন। আজ এ ধরনের ঘটনা বলিউডে প্রায়ই ঘটে থাকে। কিন্তু আশির দশকে এ ধরনের প্রয়োগ একদমই হতো না। মিউজিকে ড্রাম, বেস গিটার, সিন্থেসাইজার ব্যবহার করার ধারা তিনিই এনেছিলেন। তাই এর কৃতিত্ব দাদাকেই দিতে চাই।
লাহিড়ী হাউস থেকে টিফিন আসত
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন বাপ্পিদা। রেকর্ডিংয়ের পর যখন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি হতো, তখন দাদার বাড়ি থেকে একটা অনেক বড় টিফিনের বক্স আসত। তিনি সব সময় বলতেন, ‘ঊষাজি, আপনি আমাদের সঙ্গে বসুন।’
আমি নিরামিষাশী, তা বাপ্পিদার বাড়ির সবাই জানতেন। আর তাই আমার জন্য নিরামিষের বিশেষ বিশেষ পদ লাহিড়ী হাউস থেকে আসত। আমার জন্য থাকত লুচি, আলুর তরকারি বা সুস্বাদু ছোলার ডাল। আরও কত যে বাঙালি রকমারি পদ আমার জন্য আসত, তা বলে শেষ করতে পারব না। বাপ্পিদা মাছ খেতে ভালোবাসতেন। তাঁকে দেখতাম তারিয়ে তারিয়ে মাছ খেতে। বাপ্পিদার স্ত্রী সবার খুব খেয়াল রাখতেন। কে কী ভালোবাসে, সে ব্যাপারে ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। তাই সবার পছন্দের খাবার তিনি বানিয়ে পাঠাতেন।
প্রকৃত রকস্টার
বাপ্পিদা সোনা আর পোশাকের ব্যাপারে অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন। তিনি নিজস্ব আন্দাজে স্টাইল আইকন ছিলেন। বাপ্পিদার যে সম্মান প্রাপ্য ছিল, তা তিনি পাননি। তাঁকে নিয়ে অনেক ঠাট্টা-তামাশা করা হতো। তবে বাপ্পিদার কিছু এসে–যেত না। তিনি এসব বিষয়কে একদম পাত্তা দিতেন না। দাদা নানান ধরনের পোশাক আর সোনার গয়না পরতে দারুণ উপভোগ করতেন। ঝলমলে জ্যাকেট, কালো চশমা, কাঁধ পর্যন্ত চুল, সোনার গয়না—সব মিলিয়ে বাপ্পিদার ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্য। তিনি আংটি, জ্যাকেট আর ব্রেসলেট হরহামেশা কিনতেই থাকতেন।
বাপ্পিদার সঙ্গে দেখা হলে আমি জিজ্ঞেস করতাম, এটা নতুন কি না। তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে সবিস্তার বলতেন যে কবে, কোথা থেকে কিনেছেন। বাপ্পিদা সব সময় রকস্টার হতে চেয়েছিলেন। আর তিনিই ছিলেন প্রকৃত রকস্টার।
জোড়ি নম্বর ওয়ান
বাপ্পি দাদা আমার সঙ্গে দুর্গাপূজার ওপর গান বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। আর তার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হলো না। ছয় মাস আগে বাপ্পিদা আমায় ফোন করেছিলেন। ফোন করে বলেছিলেন যে দুই-তিনটে গান তিনি আমার জন্য রেখেছেন। আমি তা শুনে দাদাকে বলি যে গানগুলো যেন অন্য কাউকে না দেন, শুধুই যেন আমার জন্য রাখেন। আমার কথা শুনে তিনি হেসে আমায় আশ্বস্ত করে বলেন, অন্য কাউকে তিনি গানগুলো দেবেন না। তিনি আমাদের যুগলবন্দীকে ‘জোড়ি নম্বর ওয়ান’ বলতেন। আমাদের জুটি সত্যি এক নম্বর ছিল।
অনুলিখন: দেবারতি ভট্টাচার্য