সম্প্রতি আলোচিত ‘হাওয়া’ সিনেমার নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও সাড়ে তিন বছর ধরে সেন্সর ছাড়পত্র না পাওয়া ‘শনিবার বিকেল’–এর মুক্তিসহ চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বাধীনতা ও যথাযথ ফিল্ম সার্টিফিকেশন আইনের দাবিতে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পাঁচ দফা দাবিতে কর্মসূচিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা। আজ বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের দাবি ও কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরেন তাঁরা।
সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন তিন প্রজন্মের নির্মাতা ও অভিনয়শীল্পীরা। সেখানে নির্মাতাদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পিপলু আর খান। সেখানে নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে তাঁরা বলেন, এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ একজন শিল্পীর মনে যে ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি করে, তা পুষিয়ে ভবিষ্যতে নতুন কোনো কিছু তৈরির উন্মাদনা হয়তো শিল্পী আর ফিরে পাবেন না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের সংস্কৃতি, প্রগতি এবং দেশের যেকোনো শিল্পমাধ্যম এই মুহূর্তে সবচেয়ে হুমকির মুখে। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, এই দেশে কেন সেন্সর বোর্ড থাকবে? কেন ডিজিটাল অ্যাক্ট–এ ফিল্মমেকারদের হুমকি পেতে হবে? কেন বিশাল অর্থনীতিতে আর্ট–কালচারে ভিক্ষার সমপরিমাণ বরাদ্দ থাকবে?
নির্মাতাদের পাঁচ দফা দাবিগুলো হলো ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে করা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি কেন সেন্সর ছাড়পত্র পেল না, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ড বাতিল করতে হবে এবং প্রস্তাবিত চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনের ক্ষেত্রে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রস্তাবিত ওটিটি নীতিমালার ক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ওটিটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। চলচ্চিত্র বা কনটেন্টবিষয়ক কোনো মামলা করার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে। নির্মাতারা জানান, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এই দাবিগুলো নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেবেন তাঁরা। এ ছাড়া শিগগিরই এ বিষয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকও আয়োজন করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, দর্শক যে মুহূর্তে হলে ফিরেছেন, সেই সময়ে হাওয়ার নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলা ভালো ইঙ্গিত নয়। শনিবার বিকেলের সেন্সর কেন দেওয়া হলো না, তার সুস্পষ্ট জবাব চাই। যেখানে সংবিধানে মতপ্রকাশের অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেখানে শিল্পে কেন স্বাধীনতা থাকবে না।
জ্যেষ্ঠ নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, ‘হাওয়া আমরা প্রায় সবাই দেখেছি। এ কারণে এ নিয়ে সবাই কথা বলতে পারছি। “শনিবার বিকেল” অনেকেই দেখেনি। একটি বিশেষ প্রদর্শনীতি আমি ছবিটি দেখেছি। এটি এক শটে বানানো একটি ছবি। আমার মনে হয়েছে, এটি একটি অন্য রকম চলচ্চিত্র। এই ছবি মুক্তি পেলে বরং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এখনকার তরুণদের মুক্ত ও স্বাধীনভাবে সিনেমা বানাতে দিতে হবে। তাহলে তারা বিশ্ব জয় করবে।’
অভিনেতা তারিক আনাম খান বলেন, ‘ঢাকা শহরের বায়ু ও শব্দ দূষিত হওয়া নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। লঞ্চডুবিতে মানুষ মারা গেলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় এক লাখ টাকা। আর সিনেমা বানালে ২০ কোটি টাকার মামলা দেওয়া হয়। সারা পৃথিবীতে শিল্পমাধ্যমেই শিল্পীরা প্রতিবাদ করেন। আমরাও এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই। ভারত, তুরস্ক, কোরিয়া চলচ্চিত্র বানিয়ে শত শত কোটি টাকা আয় করছে। অন্যদিকে আমরা নিজেদের আটকে ফেলছি নানা আইনের জালে।’
প্রস্তাবিত চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনের সমালোচনা করে কামার আহমেদ সাইমন বলেন, ‘সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান, বোর্ড ও ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক—যে কেউ একটি ছবির সেন্সর বাতিল করতে পারবে, এটা কোনো আইন হতে পারে না। এটা স্বাধীন বাংলাদেশ। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও স্বৈরাচার আমলের আদলে কোনো আইন স্বাধীন দেশে থাকতে পারে না।’
সংবাদ সম্মেলনস্থল সাজানো হয় বিভিন্ন সময় মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের নন্দিত সব চলচ্চিত্রের পোস্টারে। আয়োজক ও সাংবাদিকদের মাঝখানে তৈরি করা হয় কাঁটাতারের বেড়া। কাঁটাতারের ওপাশ থেকে কথা বলেন নির্মাতা ও শিল্পীরা। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘সাড়ে ৩ বছর পরও সেটা জানার অপেক্ষায় আছি, কী কারণে আমাদের ছবিটা সেন্সর পেল না। শিল্পকর্ম হচ্ছে হেডলাইটের মতো। হেডলাইট বন্ধ করে রাখলে আপনারা জানতেও পারবেন না যে সামনে কী বিপদ অপেক্ষা করে আছে।’
‘হাওয়া’ ছবির পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম সিনেমায় ফুল, পাখি, নদীর গল্প বলব। সেই তালিকা থেকে এখন থেকে পাখিকে বাদ দিতে হবে। আমি নিজেই এখন খাঁচায় ঢুকে গেলাম। পরের গল্পটা আমি কীভাবে বলব? আমাদের সিনেমায় দেখানো পাখিটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। বাস্তব জীবনের আইন সিনেমার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না।’
প্রযোজক গাউসুল আলম শাওন বলেন, এখন দরকার একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এখনই সেই সময়, এক্ষুনি শুরু করতে হবে। স্বাধীন বাংলার কোনো আইন সংবিধান পরিপন্থী হতে পারে না।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান বলেন, ‘পয়লা জুলাই হোলি আর্টিজানের যে হামলা, সেটা নিয়ে প্রতিবছর লেখা হয়। দিনটায় আমার জন্মদিন হলেও আমি সেদিন জন্মদিন পালন করতে পারি না। বিভীষিকাময় দিনটা একটা কালো দিন হয়ে আছে। এ নিয়ে লিখলে, গল্প বললে, ছবি বানালে কী অসুবিধা? কাঁটাবনের পশুপাখির দোকানগুলোতে প্রাণীগুলোর সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, সেটা কি কারও চোখে পড়ে না? কেবল গল্প বললেই সমস্যা?’
নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে তাঁরা বলেন, ‘আপনাদের কার্যক্রম দেখে এই কথা অস্বীকার করার জো নেই যে আমাদের প্রগতির পথে আপনারা প্রতিনিয়ত বাধার সৃষ্টি করে চলেছেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মোরশেদুল ইসলাম, তারিক আনাম খান, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নুরুল আলম আতিক, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, কামার আহমেদ সাইমন, আবু শাহেদ ইমন, পিপলু আর খান, মেজবাউর রহমান সুমন, আদনান আল রাজীব, সৈয়দ আহমেদ শাওকি, বিধান রিবেরু, শিবু কুমার শীল। অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শম্পা রেজা, আফসানা মিমি, জাহিদ হাসান, জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, ইরেশ যাকের, জ্যোতিকা জ্যোতি, আজমেরী হক বাঁধন, আফরান নিশো, নাজিফা তুষি প্রমুখ।