বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে জনমানুষের অংশগ্রহণ, রণকৌশল, গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়াদের সাক্ষাৎকার ও চিত্র উঠে এসেছে ‘জনযুদ্ধ ৭১’ নামের প্রামাণ্যচিত্রে। আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে এটি প্রদর্শিত হয়েছে নগরের শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারিতে।
শুধু এটিই নয়, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ের গল্প নিয়ে আরও পাঁচটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে গ্যালারিতে। চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেলের তত্ত্বাবধানে নির্মিত এই প্রামাণ্যচিত্রগুলো প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হচ্ছে। প্রতিটি প্রামাণ্যচিত্রের দৈর্ঘ্য ৬০ মিনিট করে।
উদ্বোধনী দিনে প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে ও লেখিকা শারমিন আহমদ, শিল্প নির্দেশক ও অভিনেতা উত্তম গুহসহ প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালকেরা। ‘মুক্তিযুদ্ধ ৭১’ ও ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট’ যৌথভাবে প্রযোজিত এই ছয়টি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও তরুণ শিক্ষকেরা।
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে শারমিন আহমদ বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ ৭১ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। আমি অনেক দিন ধরে বাইরে বসবাস করি। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে আমার নাড়ির টান।’
এই রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের ৫০ বছর পার হওয়ার পরেও, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কতখানি কাজ হয়েছে, সে প্রশ্ন তুলে প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা, স্মৃতি সংরক্ষণ ও যাঁরা যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন, তাঁদের গল্প আরও বেশি করে প্রকাশ হতে হবে।’
শারমিন আহমদ আরও বলেন, ‘আমি যখন বীর চট্টলার বিমানবন্দরে নামলাম, তখন দেখলাম নৌ কমান্ডদের অনেক স্মৃতি থাকার কথা। যাঁরা ১৯৭১ সালে বুকে মাইন নিয়ে, গ্রেনেড নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের স্মৃতি। এ ছাড়া অনেক কৃষক বাবার ছেলে, অনেক ছাত্রের জীবন চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন, তাঁরা দেশকে কত ভালোবাসেন।’
শারমিন আহমদ আরও বলেন, ‘দেশপ্রেমের এ নিদর্শনগুলো আমরা প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে তুলে এনেছি। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের তত্ত্বাবধানে প্রামাণ্যচিত্রগুলো নির্মিত হয়েছে। এ ছয়টি প্রামাণ্যচিত্র দেশবাসীকে বিনা মূল্যে উপহার দিচ্ছি। এখানে বাণিজ্যিক কোনো স্বার্থ নেই।’
মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব বর্ণনা করে শারমিন আহমদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে অনেক নক্ষত্রের সমাগম ঘটেছিল। প্রত্যেককেই স্বীকৃতির মাধ্যমে আমরা আমাদের ভিত্তিটা মজবুত করতে পারব। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। সে অঙ্গীকার নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব।’
অনুষ্ঠানে তানভীর মোকাম্মেল বলেন, ‘আমাদের বেশ কিছু বন্ধু আছেন, যাঁরা কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি গভীরভাবে বুকে ধারণ করেন। এঁরা সবাই খুব ব্যথিত ছিলেন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এখানে বিকৃত করা হয়, ভুলিয়ে দেওয়া হয়। আমাদেরও বেদনা ছিল যে নতুন প্রজন্ম অনেক সময় সঠিক ইতিহাসটা জানতে পারেন না। এ জন্য ছয়টি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এসব প্রামাণ্যচিত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।’
চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরার উক্তি টেনে এই চলচ্চিত্র নির্মাতা বলেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হলো, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। জনগণ সঠিক ইতিহাস ভোলেনি। শাসক শ্রেণি এগুলো নিয়ে খেলা করে। ভুলিয়ে দিতে চায়। জনগণের শিল্পী হিসেবে দায় হচ্ছে, সঠিক ইতিহাস মানুষের কাছে তুলে ধরা।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তানভীর মোকাম্মেল বলেন, ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কিছু নবীন শিক্ষার্থী এবং দুজন তরুণ শিক্ষক আমার তত্ত্বাবধানে এসব প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন। তাঁদের ধন্যবাদ।’
প্রামাণ্যচিত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
আলোচনা সভা শেষে প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী শুরু হয়। শুরুতে জনযুদ্ধ ৭১ দেখানো হয়। এ প্রামাণ্যচিত্রের গবেষণা ও পরিচালনায় ছিলেন জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ, নাজিয়া মাহমুদ ও সানু মাণিক।
এরপর বিকেল পাঁচটায় বীর চট্টলার প্রতিরোধযুদ্ধ: ৭১ ও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বিলোনিয়ার যুদ্ধ প্রদর্শিত হয়। বীর চট্টলার প্রতিরোধ যুদ্ধ: ৭১ প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে গবেষণা ও পরিচালনা করেছেন ওয়াসিউদ্দীন আহমেদ, কাজী মুশফিকুস সালেহীন ও নুরুন্নবী নুর। এই প্রামাণ্যচিত্রে ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম শহরের ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দরে এসে নোঙর ফেলে পশ্চিম পাকিস্তানি অস্ত্রভর্তি জাহাজ ‘সোয়াত’। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে ওই সময়েই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আরেক বাঙালি কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরীকে ২৫শে মার্চ রাতে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনা উঠে এসেছে বীর চট্টলা প্রতিরোধ যুদ্ধ: ৭১-এ।
অন্যদিকে ‘বিলোনিয়ার যুদ্ধ’ প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে ফেনীর বিলোনিয়া যুদ্ধের দুটি পর্বের নানা ঘটনাকে। ফেনীর বিলোনিয়া যুদ্ধ হয়েছিল দুটি পর্বে। প্রথমে প্রতিরোধযুদ্ধ হয়েছিল। সেখানে মুক্তিবাহিনী এককভাবে লড়েছিল। পরে দ্বিতীয় পর্বের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন সাহায্য করেছিল। যুদ্ধের নানা ঘটনা উঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্রে। এটি নিয়ে গবেষণা ও পরিচালনা করেছেন রানা মাসুদ ও মতিউর সুমন।
শনিবার যা থাকছে
প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিন শনিবার বেলা তিনটায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৯৭তম জন্মদিন উপলক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করা হয়েছে। এরপর প্রদর্শনী শুরু হবে। বেলা সাড়ে তিনটায় মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকার, পাঁচটায় একাত্তরের নৌ-কমান্ডো এবং সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আকাশে মুক্তিযুদ্ধ কিলো ফ্লাইট প্রদর্শন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষণাধর্মী এই প্রামাণ্যচিত্রগুলোর প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।