টিভির পর্দায় রইছের সেই ‘আকনিক দৃশ্য’; পর্দার বাইরে বিজয় চৌধুরী
টিভির পর্দায় রইছের সেই ‘আকনিক দৃশ্য’; পর্দার বাইরে বিজয় চৌধুরী

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার ‘রইছ’–কে কতটা চেনেন

বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসে ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত সিনেমাটি মুক্তির প্রায় ২৭ বছর পরও দর্শকের হৃদয়ে অমলিন।

কালজয়ী এ সিনেমায় ‘রইছ’ চরিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি পরিচিতি পেয়েছেন অভিনেতা বিজয় চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাটির শেষ দৃশ্যে রইছের আত্মত্যাগ বহু দর্শককে কাঁদিয়েছে।

স্বাধীনতার পর (১৯৭৩) জন্ম হয়েছিল বলে ‘বিজয়’ নাম পেয়েছেন এই শিল্পী। তবে দর্শকের কাছে তিনি ‘রইছ’ হয়েই আছেন। সিনেমাটির দৃশ্যধারণের সময় তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর। সেই বিজয় চৌধুরী ৫১ পেরিয়ে ৫২ বছরে পা দিয়েছেন।

বিজয় দিবসে আজ প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন, স্বাধীনতার পর জন্ম নেওয়ায় তাঁর দাদি রোকেয়া হক চৌধুরী ‘বিজয়’ নামটি রেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে জন্ম নেওয়া আমার ভাইয়ের নাম বিপ্লব, আমার ছোট ভাইয়ের নাম সঞ্চয়।’

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমায় রইছের ভূমিকায় বিজয় চৌধুরী

একেই বলে শুটিং

দৃশ্যটা চিরচেনা—বুড়ির (সুচরিতা) ঘরে আত্মগোপনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে এসেছে পাকিস্তানি হানাদাররা। মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজের বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী পুত্রসন্তান রইছকে উৎসর্গ করেন মা। রইছের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে পাঠান; বাড়ির আঙিনায় রইছের বুক ঝাঁজরা করে চলে যায় হানাদাররা। আমগাছের তলায় রইছের নিথর দেহ পড়ে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে পাঠিয়ে নিথর সন্তানকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বুড়ি।

১৯৯৪ সালেই এ সিনেমায় কাজের সুযোগ পান বিজয় চৌধুরী। সে বছরই মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রামে এ দৃশ্য ধারণ করা হয়। টানা ১৮ দিন একটি বাড়িতে সিনেমার বেশির ভাগ অংশের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল।

গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজয় চৌধুরী বলেছিলেন, এর আগে দু-একটি সিনেমা করলেও গুলি খাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না বিজয়ের। গুলির দৃশ্যের কথা শুনে ভয়েই দুপুরে ভাত খেতে পারেননি তিনি। নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের অভয়ে ভয় ভেঙেছিল তাঁর।

বিজয়ের ভাষ্যে, ‘সেই সময়ে গুলির দৃশ্যে বুকে পটকা বোমা বাঁধা হতো। আমার বুকেও ট্রাকের টিউব পেঁচিয়ে ছয়টা পটকা বোমা বাঁধা হয়, এর সঙ্গে বিদ্যুতের সংযোগ ছিল। পটকা বোমার সঙ্গে বেলুনভর্তি রক্তও ছিল। হানাদারদের গুলির দৃশ্যে সুইচ চাপলেই বোমা ফাটে, রক্তে বুক ভিজে যায়। দৃশ্যটি জীবন্ত ছিল, এক টেকেই দৃশ্যটি নেওয়া হয়েছিল।’

বিজয়ের সঙ্গে নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের এক সহকারী যোগাযোগ করেন। পরে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় চাষী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন বিজয়। তাঁকে দেখেই রইছ চরিত্রে চূড়ান্ত করেন চাষী নজরুল ইসলাম। চূড়ান্ত করার ২৫ দিন পরই মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রামে সিনেমাটির শুটিং শুরু হয়।

গত বছরের ডিসেম্বরে দক্ষিণ বাড্ডার বাসায় বিজয় চৌধুরী

কনকনে শীতের মধ্যে ঝিটকায় টানা ১৮ দিনে দৃশ্য ধারণ করা হয়। ঝিটকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় দৃশ্য ধারণ করা হয়। সিনেমার পোস্টপ্রোডাকশনের কাজ শেষ হওয়ার পরও রাজনৈতিক কারণে মুক্তি পেছায়। প্রায় তিন বছর পর ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।

এর আগে ১৯৯৩ সালে পরিচালক রায়হান মুজিবের ‘প্রেমপ্রীতি’ সিনেমা দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক ঘটে বিজয়ের। মাঝখানে আরও দু-তিনটি সিনেমা করলেও রইছকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি।

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার ‘রইছ’ চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি পান বিজয় চৌধুরী

ফিরতে চান অভিনয়ে

‘মাঝখানে একটা নাটকের প্রস্তাব পেয়েছিলাম, তবে পছন্দ না হওয়ায় কাজটা করছি না। ভালো কাজ পেলে অবশ্যই অভিনয়ে ফিরব,’ আজ প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বললেন বিজয় চৌধুরী।

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার পর আর কোনো ছবি করেননি বিজয়। তিনি বলছেন, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ মুক্তির পর অনেক সিনেমার প্রস্তাব পেলেও কোনো চরিত্রই পছন্দ হয়নি তাঁর। ভালো চরিত্র না পাওয়ায় সিনেমা থেকে দূরে চলে গেছেন তিনি।

সিনেমা না করলেও মাঝেমধ্যে টুকটাক টিভি নাটকে দেখা গেছে তাঁকে। ভালো চরিত্র পেলে আবারও সিনেমা ও নাটকে নিয়মিত কাজ করতে চান তিনি।

অভিনয়ের বাইরে মূলত ব্যবসায়ী হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিজয় চৌধুরী। এর আগে মতিঝিলে ‘উনুন’ নামে একটি রেস্তোরাঁ ছিল বিজয়ের। প্রায় এক যুগ ধরে রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করেছেন তিনি। করোনাভাইরাসের মধ্যে সেটি বন্ধ করে পোশাক রপ্তানি ব্যবসায় হাত দেন।

দুই সন্তান ও স্ত্রীর সঙ্গে বিজয় চৌধুরী

কে এই বিজয়

বিজয় চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা দক্ষিণ বাড্ডায়। ১৯৯১ সালে সাভার অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৯৩ সালে ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। একই কলেজ থেকে বিকম সম্পন্ন করেছেন।

১৯৯৬ সালে বিয়ে করেন বিজয় চৌধুরী। তিনি ও তাঁর স্ত্রী সালমা চৌধুরীর সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে। বিজয়ের বাবা মোহাম্মদ মনির চৌধুরী একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, মা মিনা চৌধুরী গৃহিণী। বিজয়রা তিন ভাই ও এক বোন।