‘শুনছ, মৃণালদা মারা গেছেন!’ স্ত্রী আলোকচিত্রী মুনিরা মোরশেদ মুননিকে বললেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম। উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন আর নেই। আজ রোববার বেলা ১১টা নাগাদ কলকাতার ভবানীপুরে নিজ বাসায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর প্রথম আলোর কাছ থেকে এই সংবাদ জানতে পেরে মোরশেদুল ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। নিজেকে সামলে নিয়ে জানালেন, মৃণাল সেনের সঙ্গে তাঁদের ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। ঢাকায় যখনই তিনি এসেছেন, মোরশেদুল ইসলামের বাসায় গিয়েছেন, সেখানে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। নানা বিষয়ে তাঁদের কথা হতো। মোরশেদুল ইসলাম বললেন, ‘মৃণালদা মুননির হাতের রান্না খুব পছন্দ করতেন। অন্তত একবেলা আমাদের বাসায় খাবার খেয়েছেন। মুননি তাঁর পছন্দের সব খাবার তৈরি করত।’
মৃণাল সেনের পছন্দের খাবারের ব্যাপারে জানালেন, পাটিসাপটা পিঠা তিনি খুব পছন্দ করতেন। বললেন, ‘বৌদি মারা যাওয়ার পর আমরা কলকাতায় গিয়েছিলাম মৃণালদার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম পাটিসাপটা পিঠা। খেয়ে তাঁর সে কী প্রশংসা! তিনি উঠতে পারছিলেন না। বিছানায় শুয়ে থাকতেন। আমাদের তাঁর বেডরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। বিছানায় শুয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।’
মৃণাল সেনের সঙ্গে আপনার প্রথম কবে দেখা হয়েছিল? মোরশেদুল ইসলাম বলেন, ‘সেটা ১৯৮৫ সালের কথা। আমার “আগামী” ছবি নিয়ে ইতালির উৎসবে যাই। ভারত থেকে একটা বড় দল গিয়েছিল। সেই দলে ছিলেন মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, আদুর গোপালকৃষ্ণন, শাবানা আজমি, কুমার সাহানি, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, মণি কাউল। আমি ছিলাম খুবই ছোট। তাই আমার দিকে তাঁদের সবার মনোযোগ ছিল একটু বেশি। একসময় তাঁদের সবার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, আলাপ জমে যায়। আমি তাঁদের একজন হয়ে যাই।’
তবে মৃণাল সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার প্রসঙ্গে মোরশেদুল ইসলাম বললেন, ‘১৯৯১ সালে লন্ডনে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির সম্মেলনে আমি যোগ দিতে যাই। ওই সম্মেলনে মৃণাল সেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আর আমি এশিয়ান রিজিয়নের সেক্রেটারি। ওই সময় মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তাঁকে চোখে নিয়মিত ড্রপ দিতে হতো। আর এই ড্রপ দেওয়ার দায়িত্ব দেন আমাকে। ড্রপ দেওয়ার সময় হলেই তিনি আমাকে ডেকে নিতেন।’
১৯৯১ সালে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই সময় বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম আয়োজন করে ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব’। মোরশেদুল ইসলাম জানালেন, ওই উৎসবে মৃণাল সেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই বছর তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী গীতা সেন। পরের বছর মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র নিয়ে উৎসব আয়োজন করা হয় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে। ৩৫ মিলিমিটার প্রযুক্তিতে তাঁর কয়েকটি ছবি দেখানো হয়। মোরশেদুল ইসলাম বললেন, ‘এই উৎসবে আসার জন্য মৃণাল সেনকে আমরা আমন্ত্রণ জানাই। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে তাঁর প্রয়োজনীয় অনুমতি পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। তখন ছিল বিএনপির সরকার। আমরা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। তখন তিনি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। মৃণাল সেনকে আসার অনুমতি না দিলে কী সমস্যা হতে পারে, সেটা তাঁকে বুঝিয়ে বলেন। এরপর প্রয়োজনীয় সব অনুমতি দ্রুত পাওয়া যায়।’
১৯২৩ সালের ১৪ মে মৃণাল সেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ফরিদপুরে তিনি মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর তিনি পড়াশোনার জন্য কলকাতায় যান। ১৯৯২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠান শেষ করে তিনি ফরিদপুরে যান, নিজের জন্মভিটা দেখতে। ওই সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়াত তারেক মাসুদ।
১৯৯৮ সালে তিনি শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় আসেন। ছিলেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। মোরশেদুল ইসলাম বলেন, ‘মৃণালদা আমাকে ফোন করে বললেন, “হোটেলের খাবার আর খেতে পারছি না, আমাকে এসে নিয়ে যাও, মুননির হাতে রান্না করা খাবার খাব।” আমি গিয়ে হোটেল থেকে তাঁকে নিয়ে আসি। আমাদের বাসায় খাবার খেয়ে খুব তৃপ্তি পেলেন।’
মোরশেদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘মৃণাল সেনের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে গত বছর রেট্রোস্পেক্টিভ আয়োজন করা হয়। এই উৎসবে আসার মতো শারীরিক অবস্থা তাঁর ছিল না। শেষে আমরাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় যাই। তাঁকে নিয়ে একটি প্রকাশনা বের করেছিলাম। সেই প্রকাশনাটি তাঁর হাতে দিই। তিনি খুব খুশি হন।’