মনে করুন, একজন পুরুষ সিনেমায় একজন নারীর মন খারাপ দেখাবে। তো সে নারীকে জানালা দিয়ে উদাসী হয়ে মন খারাপ ভাব করে একদিকে তাকিয়ে থাকতে বলল। দূর থেকে জুম করে ধীরে ধীরে জানালার শিকের ওপারে মেয়েটার মুখের কাছে এসে ক্যামেরা স্থির হলো। মেয়েটার চোখে জল ছিল অথবা ছিল না। ব্যস, এটুকুই—এভাবেই একজন মেয়ের দুঃখ দেখানোর সমাপ্তি হয়। পরিচালক সুবর্ণা সেঁজুতি মনে করেন, এভাবে নারীর দুঃখকে পুরোপুরি দেখা যায় না। সেটা সম্পূর্ণ করতে হলে, দুঃখী ওই নারী কিসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কী দেখছিলেন বা আদৌ কিছু দেখছিলেন কি না, সেটাও দেখাতে হবে। তাঁর মতে, একজন পুরুষ একটা কাজল পরা নারীর চোখের দিকে তাকিয়ে চট করে তাঁর প্রেমে পড়তে পারেন। কিন্তু তিনি যদি আরও কিছুক্ষণ ওই চোখের দিকে তাকাতেন, তাহলে কাজলের ভেতরের চোখটাকে দেখতে পারতেন। হয়তো চোখের ভেতরের গভীরতাও ধরা পড়ত খানিক।
হ্যাঁ, পরিচালক সুবর্ণা সেঁজুতি সে রকমই মনে করেন। জীবনকে, নারীদের বাস্তবতাকে তিনি উপলব্ধি করেছেন সূক্ষ্মভাবে, গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। তাই ভারতের পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া থেকে ফিল্ম ডিরেকশন ও স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের ওপর তাঁর স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ফিল্মের নাম মীনালাপ। যে আলাপের কেবল শুরু আছে। যে আলাপ মূলত একজন নারীর নতুন প্রাণকে গর্ভে বেড়ে ওঠানোর, নিম্নবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে নিম্নবিত্তের ভালোবাসার সহজ অথচ শক্তিশালী বর্ণনা বা হতে পারে মহারাষ্ট্রের পুনেতে বসে এক বাংলাদেশি নারীর দেশের পানির গল্প কিংবা একটা যুদ্ধের গল্প। যে গল্প সিনেমা শেষ হওয়ার সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না। বরং বলা যেতে পারে সেখান থেকেই গল্পের শুরুটা হয়।
মীনালাপ ও অর্জন
মীনালাপ ইউরেশিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালসহ তাজিকিস্তান, ভারতের কলকাতা, শিলিগুড়ি ও মুম্বাই, আর্মেনিয়া, নেপাল, দুবাই, মিসরের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার পেয়েছে। আরও অনেক উৎসব থেকে প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু পরিচালক সুবর্ণা সেঁজুতির সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল ২৭ জুন সন্ধ্যাটা। ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে যখন হল ভর্তি সাধারণ দর্শক, পরিচালক, প্রযোজক, চলচ্চিত্রকর্মী, সাংবাদিকেরা হাততালি দিয়ে জানিয়েছেন, এই সিনেমা একটা অদ্ভুত ঘটনা, সেটা তাঁর এক বিরাট পাওয়া। সুবর্ণা সেঁজুতিও জানিয়েছেন, সবার এই ভালোবাসায় তিনি সাহস আর ভরসা পেয়েছেন। এবার তাঁর পথচলা শুরু হবে।
গল্পটা মসৃণ নয়
জীবনের পথচলা সহজ ছিল না সুবর্ণা সেঁজুতির। তাঁর জীবনের গল্প হার মানাবে বড় বড় সিনেমাকেও। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে চিত্রনাট্য লেখা, অভিনয়, মঞ্চনাটক, উপস্থাপনা, বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি, মীনা কার্টুনের গল্প লেখা—আরও অনেক কিছু করেছেন। সব একা একাই। সেই সঙ্গে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরও করেছেন। এরপর ২০১১ সালে পুনেতে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী হিসেবে চলচ্চিত্র পরিচালনা ও চিত্রনাট্য লেখার ওপর পড়ার সুযোগ এল। বাবার অনুরোধে সেখানে যাওয়ার আগে ১০ আগস্ট পাঁচ মাসের প্রেমকে পূর্ণতা দিয়ে বিয়ে করেন। ভারতে গিয়ে ভর্তির সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ফিরে আসেন।
দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরা
সেদিন ছিল ১৪ অক্টোবর। পূর্ণিমার রাত। সুবর্ণা সেঁজুতি, তাঁর স্বামী, সেঁজুতির এক ছোটবেলার বন্ধু আর তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে রাজেন্দ্রপুর গিয়ে সারা রাত চাঁদ দেখেছিলেন। গাড়ি ততক্ষণে চলে এসেছে। ফেরার সময় তাঁরা বসেছিলেন পুকুরপাড়ে। হঠাৎ পা পিছলে উল্টে পড়েন তাঁর বন্ধুর স্ত্রী, তাঁকে বাঁচাতে লাফ দিলেন তাঁর বন্ধু। আর তাঁদের দুজনকে বাঁচাতে লাফ দিলেন সেঁজুতির স্বামী। কেয়ারটেকারকে নিয়ে ফিরে এসে টুসি দেখলেন, ৩টা মৃতদেহ। ব্যস, কোমায় চলে গেলেন। ২ বছরের মধ্যে তাঁর ওজন কমে হলো ৩২ কেজি। ৬টা বড় অস্ত্রোপচার গেল। এরপর দীর্ঘদিনের যুদ্ধ শেষে তিনি সুস্থ হলেন। বেঁচে ফিরলেন।
বেঁচে থাকা ও এগিয়ে যাওয়া
সেই বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করতে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ করেছেন। পুনের দিনগুলো থেকেই ‘সাউন্ড অব ল্যাংগুয়েজ’ নামের প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছেন। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত লেখকের ছোটগল্প থেকে একটা শর্টফিল্ম তৈরির জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন। বর্তমানে নিজেদের পৈতৃক এলাকা বিক্রমপুরের গ্রামীণ আবহের একটা বাড়িতে বসে লিখছেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, যার গল্প হবে নারীনির্ভর। সেঁজুতির মতে, সিনেমা নাকি একেবারেই নারীদের বিষয়। তাঁর এই যাত্রায় তিনি কৃতজ্ঞতাভরে স্বীকার করেন কলকাতার চলচ্চিত্র সমালোচক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী প্রেমেন্দ্র মজুমদারকে। স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের তিনি গত চার দশক ধরে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে আসছেন। আর দেশের নির্মাতা নূরুল আলম আতিক আর আকরাম খানও তাঁর নির্মাতা হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
সামনের দিনগুলো
এখন আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? সুবর্ণা সেঁজুতি উত্তর দিলেন, ‘আমি সিনেমা বানানো ছাড়া আর কিছুই শিখিনি, আর কিছু জানিও না। এখন সিনেমাই আমার প্রেম। সিনেমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, আর মজার ব্যাপার হলো, এই বিয়েতে আংটি পরতে হয় না বলে আমি খুব খুশি। যদি কিছু কাজ করে শেখানোর মতো কিছু শিখতে পারি, তাহলে হয়তো একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব।’
যে যুদ্ধ দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি নিয়ে, অভিজ্ঞতা আর সরঞ্জাম জড়ো করে শুরু হয়, সেই যুদ্ধে জয় অনিবার্য। আর সেই জয়ে জিতবেন সুবর্ণা সেঁজুতি, যিনি একাধিকবার মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, মৃত্যুকে স্পর্শ করে ফিরে এসেছেন। সেই ফিরে আসার তো একটা মানে আছে!