‘দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম। দাদা, আমি যে সত্যি সত্যি বাঁচতে চেয়েছিলাম। দাদা, আমি যে বাঁচতে বড় ভালোবাসি। দাদা, আমি বাঁচব? দাদা, তুমি একবার বলো, আমি বাঁচব?’ ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে ‘নীতা’ চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবীর শেষ এই কথাগুলো বদলে দিয়েছিল এক তরুণের জীবন। তিনি পড়তে যান অর্থনীতি। এই ছবি দেখে তাঁর মনে হলো, তাঁরও এমন দুঃখ আছে, যেগুলো তিনি দেখাতে চান। সিদ্ধান্ত নেন ছবি বানাবেন। ছবি তাঁকে বানাতেই হবে। নিজের জীবনের বেদনা, সব অনুভব আর জমানো কথা তিনি এভাবেই বলতে চান। ক্যামেরা দিয়ে, অ্যাকশন আর কাটের মাঝখানে।
এরপর তিনি ভারতের পুনে ফিল্ম ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে একটা কোর্স করেন। সেখানে পড়তে গিয়ে তিনি নিজেই নিজের শিক্ষক হন। খাতা–কলম নিয়ে বসে নিজের জন্য একটা তিন বছর মেয়াদি কোর্স ডিজাইন করেন। ১৫ জন মাস্টার ফিল্মমেকার নির্বাচন করেন। তাঁদের সব ছবি দেখেন। তিন বছরে প্রায় তিন হাজার সিনেমা দেখেছেন তিনি। শুধু সিনেমা দেখেই ক্ষান্ত থাকেননি, সেই সঙ্গে যখন যে পরিচালকের সিনেমা দেখছেন, তাঁদের বই পড়েছেন। তাঁদের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেই তিন বছরে তাঁর চোখ তৈরি হয়, মন তৈরি হয়। তৈরি হন তিনি।
এরপর প্রায় ১ হাজার ১০০ বিজ্ঞাপনচিত্র বানিয়েছেন, ১০টি নাটক আর ধারাবাহিক নির্মাণ করেছেন, তৈরি করেছেন একটি চলচ্চিত্র। খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে, সেই একটা চলচ্চিত্র গত ১০ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে দর্শকনন্দিত ছবি। অনেক বছর পর ছবিটি জন্ম দেয় সেই দৃশ্যের, যে দৃশ্য যেকোনো চিত্রপরিচালকের জন্য, প্রযোজকের জন্য স্বপ্নের মতো। সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেই ছবি দেখার জন্য দর্শক ভিড় করেছে হলের সামনে। তৈরি হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন অধ্যায়।
এই একটি ছবি দিয়েই তিনি জয় করেছেন সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। শুধু তা-ই নয়, ৪১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেই চলচ্চিত্র পেয়েছে সাতটি পুরস্কার। ১৯তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ছয়টি বিভাগে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় আর পুরস্কার জিতেছে তিনটি বিভাগে। ছবির নাম ‘আয়নাবাজি’। আর যে মানুষটাকে নিয়ে এত সব শব্দের উদ্ভব, তিনি অমিতাভ রেজা চৌধুরী।
ছোটবেলায় নাকি তিনি মোটেও ‘ভালো ছাত্র’ ছিলেন না। গণিতে পেতেন রসগোল্লা। আর ১০টা ইংরেজি শব্দ লিখলে তার মধ্যে নয়টার বানান হতো ভুল! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় লিখেছিলেন জয় গোস্বামীর ‘স্নান’ কবিতার পুরোটা। ঘ ইউনিটে পরীক্ষা দেওয়ার মতো নম্বরই নাকি ছিল না তাঁর। পড়তে চেয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, নৃবিজ্ঞানে। বাবা বললেন, ‘অ্যানথ্রোপলজি তো উচ্চারণই করতে পারো না, মানুষকে বলবে কী! এই বিষয়ে পড়া যাবে না।’ তারপর পুনেতে যান অর্থনীতি বিষয়ে পড়তে। ফিরে এলেন নির্মাতা হয়ে। আর যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হতে পারেননি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এখন খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন।
জীবনে নাকি অনেকবার গল্প ও কবিতা লেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন, হয়ে ওঠেনি তা–ও। আর তাই গল্পকার, কবি, রাজনীতিবিদ—এই সবকিছুই তিনি হয়ে উঠেছেন নির্মাতা হয়ে। ‘একটা ফোন করা যাবে, প্লিজ?’—গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প অনুসারে নির্মিত এই নাটকে তিনি পাগল আর সুস্থ মানুষের সীমারেখা কমাতে কমাতে একটা বিন্দুতে এনে মিলিয়ে দিয়েছেন। ‘সার্ফেস’ নাটকে দেখিয়েছেন, দুটো ‘পারফেক্ট’ মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন। ‘বুনো ফুলের ঘ্রাণে’ নাটকে তিনি বলতে চেয়েছেন যাত্রাপালার এক নায়িকার দুঃখ–সুখের কাব্য। ‘ঢাকা মেট্রো’ ওয়েব সিরিজটি চিৎকার করে শহুরে জীবনের হতাশার কথা জানিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সিয়াম আহমেদের মতে, অমিতাভ রেজা চৌধুরী নাকি সোনার ডিম পাড়া পরিচালক। তিনি যেখানেই হাত দেন, সেখানেই সোনা ফলে। কিন্তু অমিতাভ রেজা চৌধুরী আবার দ্বিমত প্রকাশ করলেন। বললেন, তাঁর নাকি অসংখ্য কাজ আছে, যেগুলো মোটেই ভালো হয়নি। কিন্তু মানুষ শুধু ভালো কাজগুলোকেই মনে রাখে। তাই তিনি যা বানিয়েছেন, সবই দুর্দান্ত বলে একটা ভ্রম হয়। কিন্তু পরিসংখ্যান আবার কিছুটা সিয়াম আহমেদের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। কেননা, তিনি অনলাইন মাধ্যমের জন্য সম্প্রতি ‘নিঃশব্দতার শহর’, ‘বন্ধু অথবা বন্দুকের গল্প’ নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়েছেন, যার দুটিই দর্শকনন্দিত।
এরপর ‘ঢাকা মেট্রো’ নামে যে ওয়েব সিরিজটি তিনি নির্মাণ করেছেন, ১০ পর্বের সেই সিরিজ পেয়েছে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা। তারপর অনলাইন মাধ্যমের জন্য প্রযোজনা করেছেন ‘মানি হানি’ নামের আরেকটি ওয়েব সিরিজ। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত দুর্ধর্ষ ডাকাতির কাহিনি নিয়ে ওয়েব সিরিজটি নির্মাণ করেছেন তানিম নূর ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। সেটিও ভালোই নাম করেছে। বর্তমানে ‘রিকশা গার্ল’ নামের একটি চলচ্চিত্রের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। সেই সঙ্গে সব্যসাচীর মতো চলছে বিজ্ঞাপন নির্মাণের কাজ।
‘রিকশা গার্ল’ চলচ্চিত্রটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখিকা মিতালি পারকিনসের ‘রিকশা গার্ল’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হচ্ছে। ছবিটি মূলত রিকশা গার্ল নাইমাকে ঘিরে। বেঁচে থাকার লড়াই যাকে গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে পুরুষের ছদ্মবেশে রিকশা চালানোর জন্য। এই নাইমার চরিত্রে দেখা যাবে মঞ্চ ও ছোট পর্দার শক্তিশালী অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরীর মেয়ে নভেরা চৌধুরীকে। ঢাকায় এসে নাইমা আশ্রয় নেয় অভিনেত্রী চম্পার রিকশার গ্যারেজে। বড় পর্দায় দেখা যাবে, অভিনেত্রী চম্পা জীবনসংগ্রামে যুদ্ধ করা কিশোরী নভেরাকে তুলে দেবেন জীবনের নতুন সড়কে, সেখানে নভেরা তাঁর সৃষ্টিশীল মননের সদ্ব্যবহার করে হয়ে ওঠেন একজন রিকশা পেইন্টার।
‘রিকশা গার্ল’ ছবিটি মূলত ইংরেজি ভাষার ছবি। এই ছবিতে যেটুকু বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে, পরিচালকের ভাষায় সেটি ‘সাউন্ড’ হিসেবে। গাজীপুরের কবিরপুরে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটিকে চম্পার রিকশার গ্যারেজ বানিয়ে এই ছবির শুটিং প্রায় শেষ। এখন শুধু দুই দিনের শুটিং বাকি আছে। খুব যত্ন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর পরিকল্পিতভাবে নির্মিত এই ছবি যেহেতু বিদেশি ভাষার ছবি, তাই মুক্তি পাবে কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে। ‘রিকশা গার্ল’ মূলত বাংলাদেশ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য ছবিটির ভাষা ইংরেজি।
সম্প্রতি একটা কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপনের কাজ শেষ করেছেন। সেখানে মুখ্য ভূমিকায় দেখা যাবে সিয়াম আহমেদ, জাহিদ হাসান আর একটা সোনার ডিমকে। এরপর আজ শুক্রবার ও আগামীকাল শনিবার হবে হরলিকসের বিজ্ঞাপনচিত্রের কাজ। তাতে মুখ্য ভূমিকায় থাকবেন অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ও গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের মায়েরা। তবে কি চ্যাম্পিয়নদের মায়েরা সন্তানকে হরলিকস খাওয়াতেন? কে জানে!
সে যা-ই হোক, থেমে নেই অমিতাভ রেজা। জানালেন, এরপর তিনি আবারও অনলাইন মাধ্যমের জন্য আরেকটি ওয়েব সিরিজ নির্মাণের কাজে হাত দেবেন। নতুন এই ওয়েব সিরিজের নাম ‘মৃতেরা কথা বলে’। ইংরেজিতে, ‘ডেড ম্যান ক্যান টক’। এর কাহিনি লিখেছেন শিবব্রত বর্মণ আর চিত্রনাট্য লিখেছেন নাফিস আমিন।
সিনেমা ভালো নেই, কেন? অমিতাভ রেজা এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন একটু অন্যভাবে। বললেন, ‘যে দেশের মানুষেরা ভালো নেই, সেই দেশে সিনেমা কীভাবে ভালো হবে? সিনেমা তো মানুষের জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আমাদের জীবনসংগ্রাম অনেক বেশি, তাই ভালো ছবি নির্মাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সিনেমা তো সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক, শৈল্পিক একটি বিষয়। সেই সঙ্গে সিনেমা একটা সাবান বা গাড়ির মতো পণ্য। তাই সবকিছুর সমন্বয় না হলে সিনেমা ভালো হবে না।’
তবে অমিতাভ রেজা মোটেও হতাশ নন। তিনি প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ বলেই যানজট, নোংরা আর সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার ঘনত্বের এই শহর আর শহরের মানুষদের নিয়ে বলেছেন, ‘এই শহর আমার, এই মানুষ আমার।’ তাঁর মতে, এত বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি কখনো শেষ হয়ে যেতে পারে না। পরিবর্তন আসবেই। তরুণ নির্মাতাদের জন্য অনলাইন খুবই চমৎকার একটা মাধ্যম।
সিনেমা কি মোবাইলে দেখার আধেয়? জোর দিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই, কেন নয়। দিনের শেষে গল্পটা গুরুত্বপূর্ণ।’
ক্ষমতা পেলে বাংলাদেশের কী পরিবর্তন করতেন? এককথায় উত্তর ‘এফডিসি’। অমিতাভ রেজা বললেন, ‘এফডিসি থেকে সব আবর্জনা সরাতে চাই। সেই আবর্জনা হতে পারে বাদামের খোসা, চিপসের প্যাকেট বা মানুষের মনের আর চিন্তার আবর্জনা।’ বলতে হয়, ক্ষমতা তো তাঁর আছেই, দুই দশক ধরে দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। পাড়ি দিয়েছেন অনেকটা পথ। কিন্তু এই নির্মাতা মনে করেন, তাঁর যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। এখনো অনেকটা পথ পেরোনো বাকি—যে পথ বন্ধুর, যে পথ দুঃখের আর সুখের, যে পথ প্রতিনিয়ত স্বপ্নকে স্পর্শ করে নতুন স্বপ্নের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার।