২৪ এপ্রিল নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে হলিউডের ছবি ‘এক্সট্র্যাকশন’। প্রাথমিকভাবে এই ছবির নাম ছিল ‘ঢাকা’। পরে বদলে যায়। খবর ছড়ায়, ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। তাই সবার প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। কিন্তু ছবি মুক্তির পর ভেঙে যায় বাংলাদেশের দর্শকদের মন। এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ছবি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ‘এক্সট্র্যাকশন’ ছবি নিয়ে কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া থাকছে আনন্দের মূল প্রতিবেদনে।
পুরো ছবিটি নিছক কাল্পনিক ও অবাস্তব
তারিক আনাম খান, অভিনেতা
এতটা মারদাঙ্গা ছবির দর্শক আমি নই। তবে ছবির বাংলাদেশ অংশের শুটিংয়ে সীমিত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ‘এক্সট্র্যাকশন’ দেখা হয়েছে। আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিমত হলো, ছবিটি নিছকই ফিকশনাল; কাল্পনিক ও অবাস্তব। এই একটি ছবি দিয়ে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো কোনো বিষয় নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের অংশগ্রহণ সর্বত্র প্রশংসিত, বাংলাদেশের ঐতিহ্য, ভাষার ইতিহাস, পোশাকশিল্পে উৎকর্ষ—এই সব আমাদের পরিচয়। একটি ছবির জন্য এত অর্জন ধূলিসাৎ হবে বলে আমি মনে করি না।
বাংলাদেশে যখন ‘এক্সট্র্যাকশন’ ছবির শুটিংয়ের জন্য আসে, তত দিনে মূল ছবির শুটিং শেষ। এখানে তাদের খুব ছোট একটি দল (বি ইউনিটের দল), অল্প কিছু এরিয়াল শট, রাস্তার শট নিতে এসেছিল। এটার জন্য তারা না এলেও পারত। কিন্তু যেহেতু ছবিতে ‘ঢাকা’ নামের একটা শহরকে তারা দেখাতে যাচ্ছিল, তাই নিজেদের স্বার্থেই তারা অল্প কিছু কাজের জন্য এখানে আসে। আমরা সে সময় আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি ঢাকা, এমনকি পুরো বাংলাদেশের আসল ছবি তাদের সামনে তুলে ধরতে। আমরা ছবির দলকে বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, গান, নাচ, খাবার, জীবনধারা, ভাষা—এসবের সংকলনে একটি লিফলেট তৈরি করে দিয়েছিলাম।
তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, ছবিতে বাংলা ভাষার ব্যবহারে আরও যত্নশীল হওয়া যেত, ভাষার জন্য বিশেষজ্ঞ নেওয়া যেত। আমাদের কাছে তারা একবার এ ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছিল। আমরাও আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু পরে নিজেদের মতো করে তারা লোক ঠিক করে কাজটি করে নেয়। ছবিতে যে ভাষা বলানো হয়েছে, সেটা আসলে আমাদের বাংলা নয়। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, বাংলাদেশে শুটিং না হলেও নির্মাতারা কাস্টিংয়ের জন্য একটু খোঁজ করলে ‘ঢাকা’ নিবাসী চরিত্রগুলোর জন্য মেধাবী বাংলাদেশি শিল্পী নির্বাচন করতে পারত। তবে আমরা নেটফ্লিক্সের মুখপাত্র নই। তাদের চিত্রনাট্য একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ কলাকুশলী ছাড়া আর কারও কাছেই আগে থেকে প্রকাশ করা হয় না। তাই আমরাও এর চিত্রনাট্য ও নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমরা শুধু ঢাকায় তাদের শুটিং নির্বিঘ্নে করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। তৃতীয়ত, এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত, এত অস্ত্রের প্রদর্শন এবং শিশু-কিশোরদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া দেখানো অনেকের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
বাদবাকি পুরো ছবিটিই নিছক কাল্পনিক ও অবাস্তব একটি নির্মাণ। মার্কিনরা এর আগে যেভাবে মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, চীনের বিরুদ্ধে নায়ক হিসেবে তুলে ধরতে চায়, এই ছবিতেও তা–ই করেছে। তাদের দেশের চরিত্রটিকে অতিমানবীয় ক্ষমতা ও গুণের অধিকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। (অনুলিখিত)
নিজের দেশের ব্র্যান্ডিং আমাদের সিনেমা দিয়েই করতে হবে
রেদওয়ান রনি, নির্মাতা
হলিউড সিনেমার প্লট ‘বাংলাদেশ’—খুশির বেলুনটা বছরখানেক ধরে বড় হচ্ছিল। ‘থর’ অভিনেতা ক্রিস হেমসওয়ার্থ ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে সিএনজি—এমন একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর প্রত্যাশার বেলুনটা আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে। পরিচালক স্যাম হারগ্রেভের প্রথম ছবি হলেও প্রযোজক হিসেবে পরীক্ষিত ভ্রাতৃজুটি রুশো ব্রাদার্স জড়িত থাকায় দর্শক আঁটসাঁট মেরে বসেন, বিশেষ করে মার্ভেল–ভক্তদের তো ঘুম হারাম। অবশেষে ২৪ এপ্রিল তিনি এলেন, ‘এক্সট্র্যাকশন’। নেটফ্লিক্সের পর্দায় ছবিটি স্ট্রিম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে করোনা ইস্যুকে হটিয়ে ‘হট টপিক’ হিসেবে দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব শুরু করে দিল ছবিটা, যদিও প্রত্যাশার বেলুনটা তখনই চুপসে যেতে শুরু করে।
‘এক্সট্র্যাকশন'-এর মতো অ্যাকশন ঘরানার ‘পপকর্ন’ সিনেমায় দর্শক গল্পের গরু গাছে উঠলেও খুব একটা মন খারাপ করে না; যদি মারপিটের দৃশ্যগুলো মোক্ষম হয়। এই সিনেমায় মারপিটের দৃশ্যগুলো কিন্তু দুর্দান্ত, এটা যে কেউই স্বীকার করবেন। তাহলে কেন প্রত্যাশার পারদ এমন হুড়মুড়িয়ে নেমে গেল?
কারণ, বাংলাদেশি দর্শকের কাছে ঢাকার ভুলভাল উপস্থাপনা সহ্য করাই ছিল সবচেয়ে কষ্টের। ঢাকার মানুষ এভাবে বাংলা বলে না, ঢাকায় সারাক্ষণ নব্বই দশকের হিন্দি গান বাজে না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা কোনো গডফাদারকে বাঁচানোর জন্য শয়ে শয়ে মরে না।
তর্কের খাতিরে অনেকে বলছেন, কাল্পনিক ছবিতে বাস্তবতা খুঁজতে যাচ্ছেন কেন? মনে রাখতে হবে, বাস্তবতা খোঁজা আর সিনেমার স্থান-কাল-পাত্রের ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতার কারণ খোঁজা এক কথা নয়। সুপারম্যান তো পুরোটাই একটা ফ্যান্টাসি ছবি। এরপরও দেখেছেন আমেরিকার কোনো মানুষ উগান্ডার ভাষায় কথা বলে? ইংরেজিই তো বলে। সুপারম্যান তো ডকুফিল্ম না তাহলে এখানে ভাষার বাস্তবতা দেখানোর প্রয়োজনটা কী? দৃশ্যে যেন দর্শক বিশ্বাস করে, এ জন্য ফ্যান্টাসি হোক বা ডকুমেন্টারি—দৃশ্যায়নের উপাদানগুলোয় অভিনয়, সময়, লোকেশনের সংস্কৃতিকে সঠিক রাখতে হয়, এই সঠিকের মাত্রা অবশ্যই পরিচালক নির্ধারণ করেন। দিন শেষে ভুল কিন্তু ভুলই, ফ্যান্টাসি হলেই ভুল উপস্থাপন তর্কের খাতিরে ঠিক হয়ে যায় না। শুনেছিলাম, ছবির প্রযোজকেরা বাংলাদেশের একজন ডায়ালেক্ট কোচ রেখেছিলেন, যাতে অভিনয়ে ভাষা, সংলাপ, উচ্চারণ বাংলাদেশের মতো বিশ্বাসযোগ্য হয়, এটার কারণ কী? সঠিকভাবে কাজটি করার ইচ্ছাটাই এর কারণ। তাহলে সিনেমাটায় শেষমেশ কেন ভাষাটা পশ্চিমবঙ্গের বাংলা হয়ে গেল?
হয় বাংলাদেশি ডায়ালেক্ট কোচ পরিচালককে বোঝাতে পারেননি, অথবা প্রযোজক কোনো রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক কারণে ভারত যেভাবে বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছে, সেভাবেই দেখিয়েছেন। এ–ও শুনেছিলাম, ঢাকার সংস্কৃতি যেন ভুলভাবে উপস্থাপন না হয়, সে জন্য একজন সাংস্কৃতিক পরামর্শক রাখা হয়েছিল, তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে তিনি ছিলেন একজন ভারতীয়!
কস্টিউমের ভুল, অথবা সিএনজিতে তথা অন্য প্রপসের ভুলগুলো আমি মনে করি কস্টিউম ডিরেক্টর এবং শিল্প নির্দেশকের ভুল গবেষণার ফল। কোনো পরিচালকই ইচ্ছা করে নিজের ছবিতে ভুল তথ্য দিতে চাইবেন না। সেটা কোনো না কোনো কারণে ঘটে, হতে পারে সেটা রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক।
বড়লোক বড় ভাই আদর করে ডেকে নিয়ে দুটো ডাল–ভাত খেতে দিয়ে মাথায় দুটো থাপ্পড় মেরেছে বলে খুশি হওয়ার কিছু নেই। অবশ্যই বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ইমেজের জন্য এ ধরনের উপস্থাপন ক্ষতিকর। যাঁরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে না, তাঁদের কাছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে যে বার্তা যাচ্ছে, সেটাকে আসলে তাঁরা সঠিকই ভাবছেন। তাঁরা হয়তো বাংলাদেশে কখনো ঘুরতে আসবেন না, এই ছবি দেখেই বাংলাদেশের ভুল মানচিত্র আঁকবে মনের মধ্যে। আমরাও তো অনেকে সারা জীবন বিদেশি ছবি দেখে তাদের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে এ রকমই ভেবেছি! যখন এ রকম দু-একটা দেশে ঘুরতে গিয়েছি, তখন হয়তো ভুলটা ভেঙেছে। তাই এই বেদনা শুধু আমাদের নয়, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, আফ্রিকাকে হলিউড যেভাবে উপস্থাপন করেছে, এত দিনে তাদের দুঃখটা হয়তো আমরা প্রথমবারের মতো বুঝতে পারছি।
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, আমি মাঝেমধ্যে একা বাকপ্যাক ট্রাভেলে যাই। হোস্টেলে থাকি নতুন বন্ধু হয়, ঘুরি ফিরি। একবার এক কলম্বিয়ান রুমমেট পেলাম। পরিচয়ের শুরুতেই আমি ভাব নিয়ে বলে ফেললাম ‘নারকোস’ আমার প্রিয় সিরিজ। বেচারা মুখ বাঁকা করে বলল, ‘আমাদের মানসম্মান নষ্ট করছে এই “নারকোস”। তার ওপর পাবলো এস্কবারের চরিত্রটা এত বাজেভাবে স্প্যানিশ বলে যে আমরা হাসব না কাঁদব বুঝি না!’
যাই হোক, আমাদের নিজের দেশের ব্র্যান্ডিং আমাদের সিনেমা দিয়েই করতে হবে। কোরীয়দের সিনেমা এতই শক্তিশালী যে হলিউডের দু-একটা তৃতীয় শ্রেণির সিনেমায় নিজেদের ভুলভাল উপস্থাপনে কিছু যায়–আসে না।
আমাদের সিনেমাকে শক্তিশালী করার জন্য হাত-পা বেঁধে পানিতে সাঁতরাতে দিলে হবে না। নেটফ্লিক্সে বাংলাদেশের মানুষ যেমন অবাধে ‘ফিফটি শেড অব ফ্রিড’ দেখে, ‘এক্সট্র্যাকশন’ দেখে; তেমনি আমাদের নির্মাতাদেরও ক্রিয়েটিভ ফ্রিডমটা জরুরি। সিনেমাকে সেন্সর বোর্ড আটকে রেখে, এই করা যাবে না, সেই দেখানো যাবে না—এসব থেকে না বের হলে, আরেক দেশের নির্মাতা এসে এভাবেই দেশকে ভুলভাল উপস্থাপন করতে থাকবে।
তারা করলটা কী!
মৌটুসি বিশ্বাস, অভিনেত্রী
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে কয়েক দিন ধরে ফেসবুক উত্তাল নেটফ্লিক্সের হলিউড ছবি ‘এক্সট্র্যাকশন’ নিয়ে। বলা বাহুল্য, ছবিটা দেখে আমি ভীষণ রিঅ্যাক্ট করে আমার আর নির্মাতা আফজাল হোসেন মুন্নার ইউটিউব চ্যানেলে (turtle can fly) একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ভিডিও দিয়েছিলাম। দুদিন পর অনেক ভার্চ্যুয়াল কিল-ঘুষি উড়ে আসবে জেনেও আবার এ ছবি নিয়ে লেখার জন্য হাতে কলম নামের অস্ত্র তুলে নিলাম।
ট্রেলার দেখার সময় একবার মনে হয়েছিল, ‘এক্সট্র্যাকশন’ সিনেমাটা দেখব না। ছকে বাঁধা একটা গল্প, ঠিক যেন ৯০ দশকের খুব সস্তা মারদাঙ্গা হলিউড ছবি। আগ্রহের কারণ বলতে ছিল হলিউডের ক্রিস হেমসওয়ার্থ, বলিউডের পংকজ ত্রিপাঠি ও রণদ্বীপ হুদার মতো শক্তিশালী অভিনেতারা।
এই ছবির গল্পটা ভারত থেকে কিডন্যাপ হওয়া এক কিশোরকে উদ্ধারের। আর এই উদ্ধারের সময় তৈরি হওয়া ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের, মোটা দাগে এতটুকুই। ‘সি ইউ ড্যাড’ নামের একটি গ্রাফিক নোভেল থেকে মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের প্রিয়জন জো রুশো ছবিটা বানানোর চিন্তা করেন। তাঁর লেখা ও তত্ত্বাবধানে স্যাম হারগ্রেভ ছবিটি পরিচালনা করেন।
ছবিতে দারুণ একটা ওয়ান টেকের অ্যাকশন সিন থাকলেও আমার কাছে খুব একটা নতুন কিছু লাগেনি। ঢাকার কিছু ড্রোন শট ছাড়া ছবিতে আর কোনো দৃশ্যই চোখে পরেনি। হায় কপাল, এ কেমন ঢাকা? এটা কোন ব্রিজ? ব্রিজের পাশে বন এল কোত্থেকে? সিএনজি আর সাইনবোর্ডে প্রচুর ভুল বাংলা আর প্রতিটি ঘরে ৯০ দশকের হিন্দি গান। অথচ ছবিটা নাকি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বানানো! যদিও সিনেমা মানে ফিকশন, কিন্তু সেখানে সিনেমেটিক ওয়ার্ল্ডটাকে ‘মেক বিলিভ’ তো করা লাগে।
এই ছবিতে এ–ও দেখা লাগল যে দক্ষিণ এশিয়ার একটা স্বাধীন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাকি এক পিচ্চি ডনের ইশারায় চলে। ভিলেন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের পোশাক–আশাক দেখে মনে হতে থাকে দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ড্রাগ লর্ডদের গ্যাং দেখছি, যাদের বাংলাটাও বড় অদ্ভুত।
আমাদের ভুললে চলবে না আমেরিকার বড় স্টুডিওগুলো এতটাই পারফেক্টশনিস্ট যে তারা যদি কোনো এলিয়েনও দেখায়, সে ক্ষেত্রে তারা রীতিমতো নতুন ভাষা তৈরি করে নেয়। অথচ এই ছবিতে আমরা ন্যূনতম রিসার্চের লক্ষণ দেখলাম না। ছবিটা দেখে প্রশ্ন জাগে মনে, তাহলে তারা করলটা কী! একটা আন্তর্জাতিক ছবির এতগুলো ডিপার্টমেন্টে ভুল হয় কীভাবে?
শেষে আরেকটি কথা না বললেই নয়, যেসব দর্শক শুধু নেটফ্লিক্স ও রুশো ব্রাদার্সের মতো নামের সংশ্লিষ্টতার কারণে চোখ-নাক-মুখ বন্ধ করে ছবিটির সব হাস্যকর ও বিরক্তিকর দিক হজম করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের ভুলগুলো মেনে নিচ্ছেন, তাঁরাই কিন্তু শাকিব খানের মুখে সুন্দরবনের সিংহ নিয়ে বছর ধরে হাসাহাসি করেছেন। অনন্ত জলিলের হৃদয় ছিঁড়ে বের করার দৃশ্যকেও প্রচণ্ড ট্রল করেছেন। এই দ্বৈতনীতি কেন? সেই প্রশ্নটা করে গেলাম।
বাংলাদেশি হিসেবে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছি
গাউসুল আলম শাওন, প্রযোজক
কিছুক্ষণ আগে ‘এক্সট্র্যাকশন’ দেখলাম, নেটফ্লিক্সের নতুন সিনেমা। টিপিক্যাল হলিউড অ্যাকশন সিনেমা। হিরো, থরখ্যাত অভিনেতা ক্রিস হেমওয়ার্থ। যিনি একজন মার্সেনারি। টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করে কিংবা বাঁচায়। নীতির কোনো বালাই নেই। আধুনিক হলিউডি কমার্শিয়াল সিনেমার খুবই পরিচিত চরিত্র। যেই চরিত্রের মধ্যে আবার অদ্ভুত মানবিকতা জেগে ওঠে, জীবনের এক জটিল মুহূর্তে এবং শেষ পর্যন্ত সেই চরিত্র মেলোড্রামার মধ্যে দিয়ে মহান হয়ে ওঠে। আর সেই সঙ্গে জাস্টিফাই হয়ে যায় তার জীবনে করা সব অন্যায়। শেষ পর্যন্ত হিরোর জন্য আর্দ্র ভালোবাসায় দর্শকের চোখ ভিজে ওঠে।
আজকের দিনে এ ধরনের গড়পড়তা আধুনিক হলিউড কমার্শিয়াল সিনেমার উৎকর্ষের মাপকাঠি হচ্ছে কনটেক্সটের অথেন্টিসিটি। অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য চারপাশ, বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রায়ণ, বিশ্বাসযোগ্য শিল্প নির্দেশনা, বিশ্বাসযোগ্য সংলাপ এবং সংলাপক্ষেপণ—এসব আর কি। আর সাফল্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে সেই বিশ্বাসযোগ্য কনটেক্সটের ওপর দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য গল্প বলে যাওয়া। আর সেই অবিশ্বাস্য গল্প বলতে গিয়ে যদি কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রজেক্টেড রিয়েলিটি প্রদর্শনের সময় একটু এদিক–ওদিক হয়েই যায়, তাতে আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে খুব একটা সমস্যাও হয় না। আজকের এই ফেসবুকের জমানায় মানুষের স্মৃতির দৌড় নিউজ ফিডের দৈর্ঘ্যের সমান। আর তাই তো, ড্রোন শট ছাড়া অন্য তেমন কোনো শট ঢাকায় শুট না করেও পুরো সিনেমা যে ঢাকায় ঘটেছে, সেটা গায়ের জোরে দাবি করার সাহস পাচ্ছে নেটফ্লিক্স। এমন অনেক সিনেমার ক্ষেত্রে অতীতেও হয়েছে, যে সিনেমা মেক বিলিফ সেটে শুট হয়েছে। তাই ঢাকায় একদম এসেই পুরোটা চিত্রায়ণ করতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু মেক বিলিফ তো নিদেনপক্ষে হতে হবে, নাকি? আর নেটফ্লিক্স তো এটা করতেই পারে না। কারণ, যেহেতু সে এই দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যায় এক পয়সাও ট্যাক্স না দিয়ে। তাই এই দেশের প্রতি তার একটা স্বার্থপর দায়বদ্ধতা আছেই। কিন্তু কি এক অদ্ভুত কারণে, ঢাকার সব চরিত্র কলকাতার বাচনভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে। সবাই হিন্দি গান ছাড়া আর কিছু শোনে না। রাস্তাঘাট, মেইন ভিলেনের বাড়ি, কোনো কিছুতে আপনি ঢাকা খুঁজে পাবেন না। আমার এক আত্মীয় ভালো লিখেছে, ‘যেই শহরে জি-করোলা কিংবা এক্সিও নেই, সেই শহরকে আমি ঢাকা বলে মানি না।’ সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আজকের এই ইন্টারনেট বা অনলাইনের যুগে আপনি লক্ষ করেননি কিংবা ভুল হয়ে গেছে—এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আর কে লিখেছে এসব জঘন্য বাংলা সংলাপ? অবিশ্বাস্য!
আজকের যুগে সিনেমা আর রিয়েলিটির মধ্যে খুব একটা তফাত নেই। অনেক সময় তো রিয়েলিটি সিনেমার চেয়েও বেশি সিনেমাটিক। যে কারণে সিনেমা আর রিয়েলিটি একে অপরকে প্রভাবিত করে। তাই এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ফিকশন হলেও নেটফ্লিক্সের কোনো ওয়েস্টার্ন সিনেমায় বাংলাদেশের এই প্রজেক্টেড রিয়েলিটি আমাকে বাংলাদেশি হিসেবে অসম্ভব কষ্ট দিয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণায় এই সিনেমা নিশ্চিতভাবে প্রভাব ফেলবে।