অঞ্জন দত্ত সরাসরি লাইভে যোগ দিয়েই উপস্থাপিকাকে বলেন, ‘তোমার কি কোনো প্রশ্ন আছে, নাকি আমি শুরু করব? অঞ্জন দত্তের মুখে আলো কম। তাঁর হাতে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। সেই চিরচেনা কথার ধরনে শুরু হয় অঞ্জন দত্তের প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টার আড্ডা। তিনি কলকাতা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজের সরাসরি চলচ্চিত্র আড্ডায় যুক্ত হন।
এই আড্ডায় উঠে আসে, ভালোভাবে বাংলা বলতে না পারা ছেলেটি কীভাবে কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রে অঞ্জন দত্ত হয়ে ওঠেন সেই গল্প। আলোচনাজুড়ে ঘুরেফিরে আসে বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক কুমার ঘটক, মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষসহ দেশের মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও স্থান পান আলোচনায়। অঞ্জন দত্ত একাধারে গায়ক, থিয়েটারশিল্পী, অভিনেতা ও পরিচালক।
অতীত ও বর্তমান চলচ্চিত্রের তরুণ নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের অতীত নির্মাতা এবং তরুণ নির্মাতাদের সঙ্গে কাজের পার্থক্য আরব সাগরের মতো, প্যাসিফিক ওশানের মতো অনেক বড় পার্থক্য। এই সময়ের নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করলে মনে হয়, চাকরি করতে এসেছি। কারণ, তাদের মধ্যে সেই প্যাশনটা নেই। অনেক নির্মাতা স্ক্রিপ্টই পড়ে না।’ এই সময় তিনি আমাদের দর্শকের রুচি উন্নত করার কথা বলেন। দর্শকদের ভালো ছবি চাইতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দর্শক জনপ্রিয়তার পেছনে দৌড়ালে সিনেমা মারা যাবে। দর্শক চাইলে ভালো ছবি হবে। ভালো ছবি এখন না চললে কি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে চলবে? চাঁদে ভালো ছবি চলবে? ভালো ছবির পাশে দর্শককে দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি জানি, কত অল্প টাকায় বাংলাদেশে টিভির জন্য নাটক হয়। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
বর্তমান দর্শক বেশি ঝুঁকছে থ্রিলারের দিকে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সিরিয়াল কিলিং, খুনোখুনি, মারামারি, ড্রাগস—এই থ্রিলারের দিকে এখন দর্শক, নির্মাতা ছুটছেন। এটাই কি ভবিষ্যতের সিনেমা? এখন যদি সবাই লগ্নি করার আগে থেকেই চিন্তা করে, দর্শক এই, ওই ছবি দেখছে, এগুলো বানালে টাকা ফিরে আসবে; তাহলে আমরা নতুন ধারা এবং নতুনভাবে চিন্তা করা থেকে পিছিয়ে আসব।’
তরুণ নির্মাতাদের সম্পর্কে বলেন, ‘প্রথমত, যেকোনো ধরনের মানুষ চেনার ক্ষমতা থাকতে হবে, সেই চোখ থাকতে হবে। সিনেমার প্রযুক্তির জ্ঞান, সম্পাদনা, ক্যামেরার কাজ জানতে হবে। প্রচুর সাহিত্য জ্ঞান থাকতে হবে। যেটা করতে চাই, সেটা করার অদম্য ইচ্ছা থাকতে হবে। ফরমায়েশি কাজ করলে হবে না। লোকে চাইছে বলে কিছু বানালে হবে না। তুমি নিজে যেটা ধারণ করো, সেটা করো। সেই জন্য প্রচুর বই পড়তে হবে, একটা ভালো সিনেমা বারবার দেখতে হবে, অজস্র পেইন্টিং দেখতে হবে।’
এই সময় তিনি অধিকাংশ তরুণ নির্মাতার কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘আপনারা এই যে একটা গল্প বলতে যাচ্ছেন, সেটা কেন? স্ক্রিপ্টটা কেন করছেন? অনেকেই বলবে আমার ভালো লেগেছে। তোমার তো রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার ভালো লাগে। সেটা কখনো উত্তর হতে পারে না। নির্মাণের জন্য তোমার ভেতর থেকে অদম্য টান থাকতে হবে। সে জন্য দেশ–বিদেশের সিনেমা দেখো। নির্মাতার দায়টা বুঝতে শেখো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের এই আড্ডায় দর্শকদের প্রশ্ন থেকে এই নির্মাতার কাছে জানতে চাওয়া হয় বিভিন্ন প্রশ্ন। একজন দর্শক বর্তমান ওয়েব সিরিজের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে অঞ্জন দত্ত বলেন, ‘নেটফ্লিক্স থেকে শুরু করে ৭০ ভাগ অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের ওয়েব সিরিজ গার্বেজ। রাজ্যের সব গার্বেজ দর্শক দেখছে। বড় বড় অনলাইন স্ট্রিমিংগুলোতে সত্যজিৎ রায়, বার্গম্যানের মতো ক্ল্যাসিক্যাল নির্মাতার তেমন কোনো ছবি নেই কেন? সব অস্কারের ছবি দিয়ে ভরা। অথচ এই গার্বেজই নাকি ভবিষ্যতের ফরম্যাট। এর কটা ভালো বলব? ওয়েব সিরিজের সবই খারাপ। তবে ৩০ ভাগ মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ। নেটফ্লিক্স, আমাজনসহ অন্যদের দায়িত্ব নিয়ে ভালো কাজ প্রচার করতে হবে।’
বাংলাদেশের মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’ ছবির তিনি খুবই প্রশংসা করেন। জানান বাংলাদেশের সঙ্গে কলকাতার যৌথ ছবি বেশি করে নির্মাণের কথা। সেটা করলে দুই বাংলার দর্শকের কাছে ভালো ছবি পৌঁছানো যাবে। দুই বাংলা মিলে এই ছবির বড় একটা দর্শক তৈরি হবে। তাহলে ভালো ছবি বেঁচে থাকবে। তবে প্রযোজকদের ইন্টারফেয়ার করতে দেওয়া যাবে না।
সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতে অঞ্জন দত্তের অভিনয়ের কথা ছিল। সেই ছবিতে অভিনয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘“শাখা প্রশাখা” ছবির সময় তিনি একটি চরিত্র আমাকে দিয়ে করানোর কথা ভেবেছিলেন। সেটা জেনে আমি তো প্রচণ্ড উত্তেজিত। তারপর নানান কারণে সেটা হয়নি। আমার চরিত্রটি পরে রঞ্জিত মল্লিক করেছিল। আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে শুনে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলাম। ওই সময়ে আমি মৃণাল বাবুর কাছে এসে কান্নাকাটি করেছিলাম।’
শুরুতেই অঞ্জন দত্ত দার্জিলিংয়ে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ার সময়ে ছবি দেখার গল্প শোনান। সেই সময়ে তাঁর দেশ–বিদেশের নানা ক্ল্যাসিক্যাল সিনেমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তখন থেকেই তিনি হতে চান একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা। পরে কলকাতায় এসে বিভিন্নভাবে সিনেমায় জড়াতে চেষ্টা করেন। তারপর মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’ ছবিটি তাঁর মনে খুবই দাগ কাটে। চড়াই–উতরাই পেরিয়ে প্রথম সুযোগ হয় ১৯৮০ সালে মৃণাল সেনের ছবিতে অভিনয়ের। তখন থেকেই তিনি নির্মাণের কাজগুলো সেটের নির্মাতা, ক্যামেরাম্যান, লাইটম্যান, সম্পাদক এবং ছবির সেটের অন্য কলাকুশলীদের কাছ থেকে শিখতে থাকেন। পরে তিনি মঞ্চ, গান এবং পরিচালনার সঙ্গে জড়িয়ে যান। বর্তমানে গান না করা নিয়ে তিনি জানান, ‘যত দিন মানুষ গান টাকা খরচ করে দেখবে না তত দিন নতুন গান নিয়ে আসব না।’