আগামীকাল মুক্তি পাচ্ছে তৌকীর আহমেদের সিনেমা হালদা। তার আগে এক আড্ডায় এ ছবি নিয়ে মেতে উঠলেন পাত্রপাত্রীরা, জানালেন হালদার নানা ‘গোপন’ কথা। সঙ্গে ছিলেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
‘মেঘ, বৃষ্টি, আকাশ, পাতাল—কে কে আছ, একটু পানি দাও।’
‘হালদার একটা বড় ব্যাপার হলো, ছবিটির মধ্যে যিনি ঢুকে যাবেন, পাক্কা আড়াই ঘণ্টা তিনি অন্য পৃথিবীতে থাকবেন।’
টুকরা টুকরা কথা চলছে—অনেকটা ড্রেস রিহার্সেলের মতো।
তৌকীর আহমেদের সহকারীর নাম মেঘ, তাঁর কাছে পানি চাইলেন তিশা। এই অভিনেত্রী যখন ঢক ঢক করে পানি গিলছেন, তখনই ছবির পরিবেশক জাহিদ হাসানের মুখে শোনা গেল ছবিটি নিয়ে মোক্ষম এক বাক্য, ‘পাক্কা আড়াই ঘণ্টা অন্য পৃথিবীতে থাকবেন।’
আগামীকাল ১ ডিসেম্বর থেকে সেই ‘অন্য পৃথিবী’ দর্শকের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। ‘যার বুকে ঢেউ থাকে তার বুকে ঘর, জোয়ারভাটার খেলা করে না তো পর’—এত দিন তৌকীর আহমেদ পরিচালিত হালদা ছবির এই গান দেখেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কাল থেকে সারা দেশের প্রায় ১০০ প্রক্ষাগৃহে দেখতে পাবেন পুরো ছবিটি। এর মধ্যে ছবির ট্রেইলার এবং যে দুটি গান মুক্তি পেয়েছে, তা মন ভুলিয়েছে অনেকের। এখন হালদার অন্য পৃথিবীর খোঁজ জানতে চান সবাই।
অন্য পৃথিবীর নমুনা
সেই ‘পৃথিবী’র খবর জানাতেই ‘ড্রেস রিহার্সেল’ পেরিয়ে তাই ‘আসল’ আড্ডার শুরু। ছবির পরিচালক তৌকীর আহমেদকে ঘিরে তাঁর মহাখালীর অফিসে আড্ডা অবশ্য আগে থেকেই চলছিল—‘হালদা অ্যান্ড কোং’ মানে হালদার পাত্রপাত্রী তিশা, শাহেদ আলী, রুনা খান আর পরিবেশক জাহিদ হাসানের আড্ডা। কিন্তু আমাদের আনুষ্ঠানিক আলাপ শুরুর আগেই কাট মারলেন জাহিদ।
আরেক জাহিদ—অভিনেতা জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম আর ফজলুর রহমান বাবু—ছবির এই অভিনয়শিল্পীদের আড্ডায় পেলে ষোলকলা পূর্ণ হতো নিশ্চয়, কিন্তু তাঁরা না থেকেও কম ছিলেন না। তাঁদের পক্ষে দুর্দান্ত প্রক্সি দিলেন পরিচালক। তৌকীরের প্রক্সির একটি নমুনা জেনে রাখুন:
‘ছবিটি চট্টগ্রামের হালদা নদীপারের মানুষকে নিয়ে, স্বাভাবিকভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কথা বলেছেন চট্টগ্রামের আঞ্চিলক ভাষায়। তবে সারা দেশের মানুষ যাতে ভাষা বুঝতে পারেন, সে জন্য ভাষাটি খানিকটা সহজ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। তো, ভাষার কারণে শুটিংয়ের প্রথম দিকে একটু ভড়কে গিয়েছিলেন জাহিদ হাসান। একদিন আমাকে বললেন, তৌকীর ভাই, ছবিতে আমার চরিত্রটি যেহেতু একটু অবস্থাপন্ন, আমি প্রমিত উচ্চারণে কথা তো বলতেই পারি, তাই না? তাঁকে বললাম, না। তবে শেষ অব্দি তিনিসহ আমার সব পাত্রপাত্রী অসাধারণ করেছেন।
‘এই ভাষা নিয়ে কিন্তু কম কাণ্ড হয়নি। আমাদের ভাষাশিক্ষক ছিলেন ছবির সহকারী পরিচালক শিবলি। চট্টগ্রামের ভাষা শেখার জন্য আমাদের কাছে তাঁর ছিল দারুণ চাহিদা। আরও মজার বিষয় হলো, জাহিদ ভাই চট্টগ্রামের ভাষা বলতেন সিরাজগঞ্জের টানে, মোশাররফ ভাই বরিশালের টানে, রুনা আপা টাঙ্গাইলের টানে এবং আমি বলতাম নোয়াখালীর টানে। সে ছিল এলাহি কারবার।’
তিশার কথা শুনেই সবার কণ্ঠে হা-হা-হো-হো-হি-হি-হি। হাসির তুফানমেইল ছুটল।
নদী ও নারীর গল্প
হাসাহাসির আগে আনুষ্ঠানিক আড্ডার শুরুতে আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল একটু সিরিয়াস ধরনের—এত দিন পরে হালদা কেন? এর পেছনে কি কোনো দায়বোধ কাজ করেছে?
‘নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীগুলো এখন মেরে ফেলছি আমরা। হালদা চট্টগ্রামের এমন এক নদী, যেখানে মাছের প্রজনন হয়, এই নদীও আজ বিপন্ন। নদী যেমন বিপন্ন, নারীও তেমনি বিপন্ন। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করে। ছবিতে বাংলাদেশকে দেখাতে চেয়েছি আমি। হ্যাঁ, শিল্পী হিসেবে একটা দায় তো কাজ করেছেই। নদী ও নারী—দুই অনুসঙ্গ ঘিরে এগিয়েছে সিনেমার গল্প।’
কথাগুলো তৌকীরের। সেই কথায় সায় জানিয়ে মাথা নাড়ছিলেন অন্যরাও। কিন্তু ‘ছবির কাহিনি কি একটু বলা যাবে?’, ছোড়ামাত্রই প্রশ্নটি কথার গুগলিতে উডিয়ে দিলেন তিশা, ‘না না, ছবির কাহিনি ফাঁস করা যাবে না।’
তৌকীর হয়তো বলতেন, কিন্তু তিশার অনড় অবস্থানের কারণে মুখে কুলুপ আঁটলেন। শুধু বললেন, ‘আমাদের ছবিতে একটি গল্প আছে—মানবিক সম্পর্কের গল্প। আছে নারীর বিভিন্ন রূপ।’
তিশার চরিত্রের নাম হাসু। ‘হাসু চরিত্রটি আমার কাছে হালদা নদীর প্রতিচ্ছবি। নদীর যেমন বাঁক আছে, রয়েছে উত্থান-পতন, আমার চরিত্রটিও তাই। জেলে সম্প্রদায়ের মেয়ে। প্রতিবাদী।’
এখানে হাসু চরিত্রবিষয়ক একটি গোপন কথা ফাঁস করলেন পরিচালক, ‘হাসু চরিত্রে তিশাকে নেওয়ার কথা বিপাশাই (বিপাশা হায়াত) প্রথম বলেছিল আমাকে। বলেছিল, তিশা হাসু চরিত্রের সঙ্গে যাবে।’
‘আই অ্যাম গ্রেটফুল টু বিপাশা আপা!’ তিশার গলায় বিস্ময়, কৃতজ্ঞতা ও আনন্দের যৌথ নাচন।
লুকোচুরি লুকোচুরি...
ছবির শুটিংয়ের সময় ভিড় করে থাকা দর্শনার্থীদের সঙ্গে লুকোচুরিও করতে হয়েছে হালদা অ্যান্ড কোংয়ের।
তৌকীকের কথা, ‘শুটিং করতে গেলেই শত শত মানুষ ভিড়ে যেত। একবার তো লাঠিচার্জ করে ভিড় সরাল পুলিশ। শেষে নির্বিঘ্নে শুটিং করার জন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে একটু লুকোচুরি করলাম। শুটিং রাখলাম ভোর সাড়ে ৫টা থেকে। ৫টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা কোনো বাধা ছাড়াই শুটিং করতাম। দর্শনার্থীরা সাধারণত আসত ১২টার পর থেকে।’
সেই সব চরিত্রেরা
হালদায়মোশাররফ করিম বদিউজ্জামান, জাহিদ হাসান নাদের চৌধুরী, ফজলুর রহমান বাবু, মনু মিয়া, রুনা খান জুঁই আর শাহেদ আলী অভিনয় করেছেন নিবারণ চরিত্রে।
‘নিবারণ চরিত্রটি ট্রপিক্যাল বাঙালি। চরিত্রটিতে অভিনয় করতে গিয়ে খুব আনন্দ পেয়েছি।’ শাহেদের কথার পর তৌকীর জানিয়ে দিলেন আরেক গোপন কথা, ‘আদতে এটা শাহেদের পুরস্কার। আমার আগের সিনেমা অজ্ঞাতনামায় ও এত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছিল যে ওকে কাস্ট করেছিলাম চরিত্রটি রচনারও আগে।’
এক বাক্যে নিজের চরিত্র সম্পর্কে মেলে ধরলেন রুনা খান, ‘আমি বলব না জুঁই এ ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, তবে জুঁই ছাড়া গল্পটি সম্পন্নও হয় না।’ সঙ্গে এটিও জানাতে ভুললেন না, ‘এ ছবির শুটিংয়ের সময় তৌকীর ভাই ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর মতো নানা কিছু করেছেন।’
কেমন?
রুনার কথা কেড়ে নিলেন তিশা, ‘শুটিংয়ের প্রথম দিকে তৌকীর ভাই একবার জাহিদ ভাইকে কল দিলেন ভোর পাঁচটায়, সাড়ে পাঁচটায় শুটিং হবে। আমি ভাবলাম, এত ভোরে জাহিদ ভাই কি উঠবেন? ওমা, পরদিন চারটা কি সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠেই দেখি জাহিদ ভাই বসে আছেন।’
‘আসলে জাহিদ ভাইয়ের মতো জ্যেষ্ঠ অভিনেতা যদি এত ভোরে উঠতে পারেন, তবে আমরা কোন ছার—এই ছিল পরিচালকের কৌশল। কৌশলটি কাজে লেগেছে।’ যোগ করলেন রুনা।
এবং অবশিষ্ট
মাত্র ২২ দিনে শুটিং শেষ। বাজেট ছিল অপেক্ষাকৃত কম। তবু হালদা নিয়ে আশাবাদী পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীরা। কেন?
‘হালদায় একটি নিটোল গল্প আছে। গান আছে। বিনোদনমূলক সিনেমায় যা যা থাকা দরকার সবই আছে।’
আর হালদার গানেই তো আছে, ‘আহা জীবন, কত ভালোবাসাবাসি’—ভীষণ ভালোবাসা দিয়ে এই সিনেমার শিল্পী-কুশলীরা ছবির ক্যানভাসে কেমনভাবে ‘নোনাজলে হাসাহাসি’ করেছেন?
চলুন এবার সেটুকু দেখি হলের পর্দায়।