আকাশ দেখতে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন তারাদের দেশে চোখ রাখতে। দূরের গ্রহ-উপগ্রহ দেখে কক্ষপথে হারিয়ে যাওয়ার নেশা ছিল সুশান্ত সিং রাজপুতের। প্রিয় টেলিস্কোপ দিয়ে দুচোখ ভরে রাতের আকাশে তারাদের আনাগোনা দেখার শখ ছিল তাঁর। এমনকি সোনচিড়িয়া ছবির শুটিংয়েও নিয়ে গিয়েছিলেন টেলিস্কোপটি। সবাইকে দেখিয়েছিলেন তাঁর রাতের সঙ্গীকে (টেলিস্কোপ)। ছোট্ট শিশুর মতো বাঁধনহারা আনন্দে সেদিন সেটে মেতে উঠেছিলেন সুশান্ত। আজ ৩৪ বছরের এই তরুণ নায়কটিই তারার দেশের বাসিন্দা। ১৪ জুন তিনি আত্মহত্যা করেন। ভারতের মুম্বাইয়ে সুশান্তের নিজ বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় তরুণ এই বলিউড তারকার ঝুলন্ত নিথর দেহ।
কাই পো ছে দিয়ে বলিউড–যাত্রা শুরু সুশান্ত সিং রাজপুতের। এর আগে জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘পবিত্র রিস্তা’-র মাধ্যমে সবার নজর কেড়েছিলেন তিনি। এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড ছবিটি মুক্তির আগে প্রথম দেখা তাঁর সঙ্গে। এরপর যতবারই দেখা হয়েছে ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি এনে বুঝিয়ে দিতেন তিনি দারুণ আছেন।
সুশান্তের সঙ্গে শেষ দেখা অভিষেক চৌবে পরিচালিত সোনচিড়িয়া মুক্তির আগে। মুম্বাইয়ের সান অ্যান্ড স্যান্ড হোটেলের সেই আড্ডায় ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করতেই সুশান্তের জবাব ছিল, ‘আমি এখন দারুণ আছি। আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না যে আমি কতটা আনন্দে আছি। ১২ বছর আগে নাটক করতাম। ২৫০ রুপি পেতাম রোজ। আটজনের সঙ্গে একটা ঘরে থাকতাম। তখনো আমি ভালো ছিলাম। নিজের কাজ নিয়ে এতটাই আনন্দে থাকতাম যে মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমাতাম।’ এত খ্যাতি, এত অনুগামীকে হারানোর ভয় করে না, জবাবে মুচকি হেসে তিনি বলেছিলেন, ‘একদমই না। কী আর হবে? ১২ বছর আগের জীবনে আবার ফিরে যাব। সবকিছু হারালেও আমার মঞ্চ তো আছেই।’ এভাবেই সেদিন আশার কথা শোনানো মানুষটি নাকি হতাশায় ভুগে মারা গেলেন! এখনো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেকের। অনেকের মনে আত্মহত্যা, নাকি হত্যা—এমন সন্দেহেরও উদয় হয়েছে। তদন্ত করছে গোয়েন্দা বিভাগ।
বলিউডের তথাকথিত ইঁদুরদৌড়ে বিশ্বাসী ছিলেন না এই তরুণ তুর্কি। প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গে সুশান্ত বলেছিলেন, ‘এক নম্বরে পৌঁছালে কী হবে? আমার আরও অর্থকড়ি হবে। যা এক জীবনের জন্য অর্থহীন।’
বিহারের পাটনা থেকে মুম্বাইয়ে এসে বলিউডে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন নিজের জায়গা। ছোট শহর থেকে উঠে এসেছেন বলে হামেশাই তাঁকে কটাক্ষ করা হতো। তবে তাঁর কথায়, শহর ‘ছোট’ বা ‘বড়’ হয় না। মানুষের চিন্তাভাবনা ছোট হয়। সব শহরের সঙ্গে নিজস্ব আবেগ জড়িয়ে থাকে। শুধু সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশটা শহরভেদে ব্যতিক্রম হয়।
হাসিখুশি, প্রাণবন্ত এবং শান্ত স্বভাবের সুশান্ত। নিজের চারপাশে এঁকেছিলেন এক অদৃশ্য গণ্ডি। ছিলেন মেধাবী ছাত্র। প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা ছেড়ে অভিনয়জগতে এসেছিলেন। নিজের ছন্দে চলতে ভালোবাসতেন। নিভৃতবাস ছিল তাঁর পছন্দের। বাড়ির একটা ঘরকে সাজিয়েছিলেন একটুকরো চাঁদের মতো করে। সুশান্ত বলেছিলেন, ‘আমার যা করতে ইচ্ছে হয়, আমি তা-ই করি। ঠিক বা ভুল সিদ্ধান্ত যা-ই নিই, তার দায়ভার আমারই। সারা দিনে দুবার ভুল কাজ করার জন্য আমি নিজেকে ছাড় দিই। ভুল করতে ভয় পাই না। বরং প্রতিটা ভুলের জন্য গর্ববোধ করি। আমি চাই জীবনে সফলতা-ব্যর্থতা দুটোই আসুক।’
সিনেমার বাইরেও সুশান্তের এক স্বপ্নের দুনিয়া ছিল। তিনি আর তাঁর ৫০টি স্বপ্নপূরণের কথা সেই দুনিয়ায়। নানা ধরনের দাতব্যকাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সুশান্ত। বলেছিলেন, ‘নানা ধরনের কাজের মধ্যে একটি হলো, আমি ছাত্রদের নাসায় পাঠাই। সাতটা পরিবারের দায়ভার নিয়েছি। কেরালা, নাগাল্যান্ডের ত্রাণ তহবিলে নিজের পকেট থেকে কোটি টাকা দিয়েছি। আসলে আমার ভেতরে যা কিছু ভালো, সব পেয়েছি আমার বাবা, মা আর চার বোনের কাছ থেকে। আমি বাড়িতে সবার ছোট আর একমাত্র ছেলে। তাই আমি সবারই আদরের।’
আজ সুশান্তের এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য অনেকে বলিউডের কিছু নির্মাতাদের দায়ী করছেন। শোনা যাচ্ছে, দেড় বছরের বেশি সময় তিনি রুপালি পর্দা থেকে দূরে থাকার কারণ বলিউডের নামজাদা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যশরাজ ফিল্মস। তবে এই কথা সুশান্ত নিজে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি সব সময় সেই ছবিটা করি যেটা আমি করতে চাই। কোনো ব্যানারের হস্তক্ষেপ আমার জীবনে বা আমার ক্যারিয়ারে নেই।’
সুশান্তের মৃত্যুর পর একটা প্রশ্ন সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে ‘কিন্তু কেন?’ তাঁর এই চরম ভুলের দায়ভার কে নেবে? ‘চার কদম, ব্যস চার কদম’—আরও অনেক পথ বাকি রেখে চলে গেলেন তিনি।