বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক যায় দিন ফাগুনো দিন (১৯৭৬) যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের স্মৃতি থেকে কখনোই মুছবে না গায়েন চরিত্রের গেরুয়া পোশাকধারী সেই সুদর্শন, সুকণ্ঠের তরুণটির কথা। চট্টগ্রামের পথের মোড়ে মোড়ে, হাটে-মাঠে-ঘাটে একসময় অভিনীত হতো মিলন চৌধুরী রচিত ও নির্দেশিত নাটকটি। এতে কি গানে, কি অভিনয়ে দর্শকদের মনে মুগ্ধতা ও বিস্ময় জাগিয়ে তুলেছিলেন তরুণ শান্তনু বিশ্বাস।
এরপর সময় গড়িয়েছে আর শান্তনুর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে শিল্প-সান্নিধ্যে, সৃষ্টির উন্মাদনায়। কখনো নাটক, কখনো গান। নাটকের দল গড়ে তুলেছেন। নিজে নাটক লিখে সেই নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রে। আবার গানের জগতে নিজের লেখা গানে নিজে সুর দিয়ে গেয়েছেন, নিজের লেখা গান ও সুর তুলে দিয়েছেন সেরা শিল্পীদের কণ্ঠে।
সেই যে ৪৬ বছর আগে দর্শকের সামনে নিজেকে হাজির করেছিলেন একটি সপ্রতিভ তরুণ, ৬৫ বছরের পরিণত বয়সে মৃত্যুর (১২ জুলাই) মাত্র ১৫ দিন আগেও দাপটের সঙ্গে তিনি অভিনয় করলেন নিজের লেখা ও নির্দেশিত নাটকে। একরকম মঞ্চ থেকে দর্শকদের অভিবাদন জানিয়েই যেন বিদায় নেওয়া। জানি না এতে তাঁর শিল্পীজীবনের বৃত্তটা পূর্ণ হলো কি না। কিন্তু এতটাই সপ্রাণ ও সচল ছিলেন তিনি, একটা গভীর অতৃপ্তি রয়ে গেল ভক্ত-অনুরাগীদের মনে।
মুক্তিযুদ্ধে নিজের বড় ভাইকে হারিয়েছিলেন শান্তনু। সেই ক্ষোভ ও বেদনা বুকে নিয়ে সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্ত হয়েছিলেন নাটকের সঙ্গে। গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়, অঙ্গন থিয়েটার ইউনিটের বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের পর নিজেই গড়ে তুলেছিলেন নাট্যদল ‘কালপুরুষ’। তাঁর প্রথম লেখা নাটক কালো গোলাপের দেশ। এরপর একে একে লিখেছেন নবজন্ম, দপ্তরী রাজদপ্তরে, ইনফরমার, ভবঘুরে, নির্ভার প্রভৃতি নাটক। এই সব কটি নাটকেই অভিনয় করেছেন তিনি। কোনো কোনোটির নির্দেশনার দায়িত্বও পালন করেছেন। মৌলিক নাটকের পাশাপাশি বেশ কিছু নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তরও করেছেন। তাঁর নির্দেশিত জুলিয়াস সিজারের শেষ সাত দিন, মানুষ ও নিয়তি এবং মৃনালের চিঠি এই অঞ্চলের নাট্যদর্শকদের নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছিল।
মঞ্চের সহশিল্পী শুভ্রা বিশ্বাসকে বিয়ে করেছিলেন ১৯৮৪ সালে। মঞ্চে এই শিল্পীদম্পতির বোঝাপড়া ও রসায়ন অভিনয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। বিশেষ করে কালো গোলাপের দেশ, নবজন্ম, জুলিয়াস সিজারের শেষ সাতদিন ও সর্বশেষ অভিনীত নির্ভার নাটকে শান্তনু-শুভ্রার অভিনয়নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক। কবি সিলভিয়া প্লাথ বলেছিলেন, ‘মৃত্যু কী নিপুণ শিল্প!’ সেই আকস্মিক মৃত্যু বিচ্ছিন্ন করে দিল সংসার ও মঞ্চের এই মণিকাঞ্চন জুটিকে।
গানের জগতে শান্তনুর সবচেয়ে বড় স্বাতন্ত্র্য তাঁর নিজের লেখা গানের কথা ও সুর। সংগীতে হাতেখড়ি শৈশবে। ওস্তাদ সৌরীন্দ্রলাল দাশগুপ্ত, ওস্তাদ নীরদ বড়ুয়া ও ব্রাদার হ্যামেলের কাছে তালিম নিলেও নাটক নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দীর্ঘকাল মঞ্চ-টিভিতে গান করেননি, অ্যালবামও বের করেননি। ২০০৭ সালে তাঁর কথা ও সুরে বেশ কটি গান করেন শিল্পী সুবীর নন্দী ও কলকাতার ইন্দ্রানী সেন। এরপরের বছরই নিজের লেখা ও সুরে অরুনিমা ইসলামের সঙ্গে দ্বৈত গানের সংকলন বের হয় তাঁর। তখন থেকেই তাঁর গানের আলাদা বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে পারেন সংগীতপিপাসুরা। এরপর একে একে শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে যৌথ এবং আরও দুটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয় শান্তনুর। মঞ্চ ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তখন থেকে একক সংগীত অনুষ্ঠান করে শ্রোতা-দর্শকদের নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি।
কর্মজীবনে ইস্পাহানি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে কখনো ছেদ পড়েনি। শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে গভীর আগ্রহ, এ বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা তাঁকে পরিপূর্ণ রুচি ও সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিল। প্রসেনিয়াম নামের একটি মননঋদ্ধ নাট্যপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। এ ছাড়া বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন ও আলোচনা-সমালোচনায় এই বিদগ্ধ মানুষটিকে চিনেছি আমরা।
মৃত্যুর অনেক আগে ২০১৫ সালে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করে গিয়েছিলেন এই শিল্পী। তাঁর সেই ইচ্ছানুযায়ী তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যার সম্মতিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে তাঁর মরদেহ দান করা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ হিসেবে। স্বল্পায়ু জীবনের সমাপ্তিটাকেও এভাবেই মহিমা দিয়ে গেলেন শিল্পী।
একটি গানের কথায় শান্তনু লিখেছিলেন, ‘কাঁঠালচাঁপার গন্ধে বিভোর বাতাস/ মাথার ওপর ছোট্ট একটি আকাশ/ মাঠের কোণে উদাস বিজন ঘাস/ চাঁদের আলোয় চন্দ্রমল্লিকা/ সবই আমি যত্ন করে রাখি/ তোমায় দেব আবার দেখা হলে।’
বিদায় শান্তনু। আবার, বারবার দেখা হবে সুরে ও বাণীতে।