সীমানা পেরিয়ে 'মেড ইন বাংলাদেশ'

মেড ইন বাংলাদেশ ছবিতে রিকিতা নন্দিনী ও নভেরা
মেড ইন বাংলাদেশ ছবিতে রিকিতা নন্দিনী ও নভেরা

৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। নিউইয়র্ক আফ্রিকান ডায়াসপোরা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হলো মেড ইন বাংলাদেশ। প্রদর্শনী শেষে আফ্রিকার এক নারী পরিচালক রুবাইয়াত হোসেনকে বললেন, ‘আমি চাই, আপনি জীবনভর ছবি বানান। প্রয়োজনে আমি খরচ জোগাব। কিন্তু আপনি কখনো ছবি বানানো বন্ধ করবেন না।’ বিজয়ের মাসে ভিনদেশি এক নির্মাতার কাছ থেকে বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে এমন মন্তব্য কোনো অর্জনের চেয়ে কম নয়।

দেশের বাইরে দেশ
অসংখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তরিক প্রশংসা ও ৫টি পুরস্কারজয়ী মেড ইন বাংলাদেশ ছবিটি বর্তমানে চলছে ফ্রান্সের ৫৩টি, ডেনমার্কের ৭টি ও পর্তুগালের ১টি প্রেক্ষাগৃহে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশ, ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও পর্তুগালের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত মেড ইন বাংলাদেশ–এর ফরাসি প্রযোজক ফ্রাঁসোয়া দ্য আক্তেমেয়ার। বাংলাদেশের স্বাধীন ধারার নির্মাতাদের জন্য এটি আশা ও আনন্দের ঘটনা। মাটির প্রজার দেশেখ্যাত নির্মাতা বিজন ইমতিয়াজ তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যেখানে ছবিতে নাচ-গানের দৃশ্য না থাকলে দেশের একটা সিনেমা হল পেতেই সংগ্রাম করতে হয়, সেখানে এটা অনেক বড় অর্জন। এই ছবির পুরো দল কেবল নিজেদেরই নয়, আমাদেরও পথ দেখাল, সাহস জোগাল, অনুপ্রাণিত করল।’ আগামী বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পোল্যান্ডেও মুক্তি পাবে এই ছবি। তারেক মাসুদের মাটির ময়নার (২০০২) পরে এ ছবিটিই দেশের বাইরে এতগুলো প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে। বিজয়ের মাসে এমন সুখবর বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমী ও বোদ্ধাদের জন্য সত্যিই আনন্দের। ২০২০ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশের মানুষ ছবিটি দেখতে পারবেন বলে আশা করছেন এই পরিচালক।

যাঁকে নিয়ে মেড ইন বাংলাদেশ সেই ডালিয়ার সঙ্গে নির্মাতা রুবাইয়াত (বাঁয়ে)

জীবন যেখানে যে রকম
ডালিয়াকে জোর করে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল তাঁর পরিবার। তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান ১১ বছর বয়সী মেয়েটি। তারপর কত যুদ্ধ! কিছুদিন এক বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করার পর এই গার্মেন্টস, সেই গার্মেন্টসে ঘুরে ঘুরে অবশেষে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন শ্রমিকনেতা হিসেবে। সিনেমার নয়, এটা সত্যিকারের ঘটনা। মেড ইন বাংলাদেশ এই ডালিয়ার জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত। ডালিয়া থেকেই তৈরি হয়েছে এ ছবির ‘শিমু’ চরিত্রটি। বড় পর্দায় যিনি শিমু হয়ে উঠেছেন, তাঁর ডাকনামও শিমু; সবার কাছে এই শিল্পী পরিচিত রিকিতা নন্দিনী নামে। পরিচালক রুবাইয়াতের সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছেন সত্যিকারের শ্রমিকনেতা ডালিয়া আক্তারও। প্রদর্শনী শেষে দর্শক সিনেমার কলাকুশলীদের পাশাপাশি সরাসরি কথা বলেছেন রক্তমাংসের সেই জীবনযোদ্ধার সঙ্গে, যাঁর গল্প অবলম্বনে তৈরি মেড ইন বাংলাদেশ।

রুবাইয়াতের ভেতর মৃণাল সেনের ছায়া
গত ৬ সেপ্টেম্বর মেড ইন বাংলাদেশ ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ৪ ডিসেম্বর এ ছবি মুক্তি পায় ফ্রান্সে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চলচ্চিত্র সমালোচক ও বিশ্লেষক চার্লস টেসন ছবিটি দেখে তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মৃণাল সেনের একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯) আর খারিজ (১৯৮২) ছবির সঙ্গে রুবাইয়াত হোসেনের মেড ইন বাংলাদেশ ছবির তুলনা চলে। এই ছবিতেও একইভাবে নিরবচ্ছিন্ন বাস্তবতা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, নরওয়ে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের দর্শক ছবি শেষ হওয়ার পর জানতে চেয়েছেন, এরপর কী হলো? জানতে চেয়েছেন, এই নারীরা (বাংলাদেশের নারী পোশাককর্মীরা) এত শক্তি আর সাহস কোত্থেকে পান? এই প্রশ্নের উত্তর ছবির পরিচালকেরও জানা নেই। শুধু বলেছেন, এই নারীরা তাঁকে আরও সাহসী করেছে।

বাংলাদেশের নারীরা এত শক্তি
কোথায় পান? 
এই ছবি নির্মাণ করে এখন পর্যন্ত আপনার সবচেয়ে বড় অর্জন কী? সুদূর নিউইয়র্ক থেকে এই প্রশ্নের জবাবে ছবির পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন বললেন, ‘দিনশেষে ২০১৩ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবিটি কিন্তু বাংলাদেশের নারীদের শক্তি, ক্ষমতা আর ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলে। এই ছবি দেখেই ডালিয়া নিজের ভেতরের শক্তিকে অনুভব করেছেন। এই ছবিই তাঁকে বুঝিয়েছে যে তিনি আসলে কী করেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এই নারীদের প্রতি আমার যে দৃষ্টিভঙ্গি আর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে, সেটিই এই ছবি থেকে আমার সবচেয়ে বড় অর্জন।’

মেহেরজান ও আন্ডার কনস্ট্রাকশনখ্যাত এই পরিচালক এখন মুখিয়ে আছেন দেশের মানুষকে তাঁর নতুন ছবিটি দেখাবেন বলে। তাঁর প্রধান দর্শক বাংলাদেশের নারী পোশাকশ্রমিকেরা।