‘আমরা হয়তো ভাবি সিনেমা নাচ-গানে ভরপুর কিছু একটা। আরও মোটাদাগে বললে, দরিদ্র লোকের জন্য স্থূল বিনোদন। এটা মোটেও তা না। চলচ্চিত্র বাংলাদেশের প্রচার হতে পারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।’ কথাগুলো অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদের। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত নতুন ছবি ‘ফাগুন হাওয়ায়’-এর ফার্স্টলুক প্রকাশের অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তৌকীর।
বেশ কিছুদিন আগে শুটিং শেষ হয়েছে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিশা ও সিয়াম। ছবির ফার্স্ট লুকে দেখা গেছে, তিশা ও সিয়ামের গায়ে জড়ানো পঞ্চাশের দশকের পোশাক। সাজসজ্জা দেখেও বোঝার উপায় নেই যে তাঁরা এই সময়ে বাস করেন। আদ্যোপান্ত পঞ্চাশের দশকের আবহেই হাজির তাঁরা। ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত ‘ফাগুন হাওয়ায়’ শুধু পোশাকে নয়, তিশা ও সিয়াম এক হয়ে রাজপথে নেমেছেন বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। ছবির ফার্স্ট লুকে তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে।
নির্মাতা তৌকীর আহমেদ বলেন, ‘“ফাগুন হাওয়ায়” আমরা একটি মফস্বলে সেই সময়ের মানুষের ভাবনা, আন্দোলন, চেতনাকে রূপক অর্থে তুলে ধরেছি, যা ঢাকা শহরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে। আমি মনে করি অভিনয়শিল্পীদের সুঅভিনয় এবং সুনির্মাণের যে চেষ্টা করেছি, তাতে দর্শকদের ভালো লাগবে। সেই আশা নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। যদি ভালো লাগে, ছবিটি থেকে যাবে। এটির একটি আর্কাইভ্যাল মূল্যও আছে।’
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৌকীর নির্মাণ করেছিলেন ‘জয়যাত্রা’ ছবিটি। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির ফার্স্টলুক প্রকাশের দিনে সেই ছবিটির প্রসঙ্গও চলে আসে। কথা প্রসঙ্গে তৌকীর বলেন, ‘আমি “জয়যাত্রা” নামে একটি ছবি বানিয়েছিলাম। শুনেছি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি ১৮ হাজার দর্শক দেখেছেন। বাকি সব দর্শক টেলিভিশনের। এ নিয়ে আক্ষেপের কিছু নাই, এটা বাস্তবতা। আমাদের দেশে এই ধরনের ছবির দর্শক এখনো সেভাবে তৈরি হয়নি। অতি সম্প্রতি লক্ষ্য করছি, চলচ্চিত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক নির্মাণের কথা শুনছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনী নিয়ে “হাসিনা: এ ডটার’স টেল”ও দেখলাম, যেখানে জাতীয় ইস্যু কিংবা ও জাতীয় ইতিহাস উঠে এসেছে। আমি মনে করি, এ দুটি ছবি থেকে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার একটি যাত্রা শুরু হবে। কারণ সিনেমা এমন একটি মাধ্যম, যেটার গুরুত্ব অপরিসীম। এই মাধ্যম যদিও তরুণ একটি মাধ্যম, মাত্র ১০০ বছরের কিছু বেশি হয়েছে। আমরা দেখেছি এই সময়ের মধ্যে অনেক রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের প্রচারের জন্য, রাষ্ট্র গঠনের জন্য, মানুষ গঠনের জন্য সিনেমাকেই ব্যবহার করেছেন।’
তৌকীরের সিনেমাগুলো দেশের পাশাপাশি বাইরের দেশের বিভিন্ন উৎসবেও প্রশংসিত হয়। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সেই প্রসঙ্গও আসে। তৌকীর বলেন, ‘আমরা দেশের বাইরে বিভিন্ন উৎসবে যাওয়ার চেষ্টা করি। অনেক সময় নির্বাচিত হই না। আবার যেখানে নির্বাচিত হই, কোথাও আমরা পুরস্কৃতও হই। আমরা কিন্তু সেখানে জাতীয় পতাকাই বহন করি। চলচ্চিত্র আমাদের শুধু শিক্ষা দেবে না, বিনোদনও দেবে। সিনেমার আর্কাইভ্যাল মূল্যও থাকে। যেমন আমার “জয়যাত্রা” বছরের প্রতি মার্চ ও ডিসেম্বর মাসে দেখানো হয়। একদিন তো শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ওই পথে যাচ্ছিলাম। দেখি স্ক্রিনে একটি সিনেমা চলছে। ভাবলাম, এখানে আবার কী সিনেমা দেখাচ্ছে? তাকিয়ে দেখি আমারই ছবি “জয়যাত্রা”। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে।’
টিটো রহমানের ‘বউ কথা কও’ গল্পের অনুপ্রেরণায় নির্মিত হয়েছে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমা। এই সিনেমায় তিশা, সিয়াম ছাড়া অভিনয় করছেন আবুল হায়াত, আফরোজা বানু, ফারুক হোসেন, সাজু খাদেম, আজাদ সেতু, বলিউডের অভিনেতা যশপাল শর্মা প্রমুখ। ফার্স্টলুক প্রকাশের দিনে জানানো হয় ছবিটির মুক্তির তারিখও। তৌকীর জানান, আসছে ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মহাসমারোহে ছবিটি মুক্তি দিতে চান।
নতুন ছবিটি প্রসঙ্গে তৌকীর বলেন, ‘আমাদের জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই একুশে ফেব্রুয়ারিতে একাত্তরের সূচনা হয়েছিল। আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, পাকিস্তানিদের কাছে আমাদের ভবিষ্যৎ নেই। সেই প্রেরণাতেই আমরা স্বাধীন জাতি। আমরা ক্রমাগতভাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছি। জাতীয় পর্যায়ে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইমেজ তুলে ধরছি। এই পরিবর্তনের সঙ্গে চলচ্চিত্র একটা হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। আমরা যখন বিদেশে যাই, আমাদের ছবি যখন বিদেশিরা পছন্দ করেন, তখন কিন্তু বিদেশিরা ভাবেন, আমরা শুধু মানবসম্পদ রপ্তানি করি না, আমরা একটি উজ্জ্বল সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ধারণ করি। বাংলা ভাষা, পৃথিবীর সুমিষ্টতম ভাষা। শ্রুতিমধুর জায়গা থেকে এই ভাষাকে সুমিষ্ট ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় কথা বলে। সেই ভাষার আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরব না কেন? আমার মনে হয়, আমাদের জাতিসত্তার মূলই হচ্ছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। কিন্তু মহান ওই ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমায় কোনো পূর্ণাঙ্গ কাজ হয়নি। বর্তমানে আমি এই কাজটি করতে পেরে ভীষণ খুশি।’
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবিতে নাসির চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ। ৬৬ বছর আগের চরিত্রে অভিনয় করতে কেমন লাগছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাবার নামও নাসির। যখনই শুনলাম আমাকে এই ছবির মূল চরিত্রের জন্য মনোনীত করা হয়েছে, তখনই বেশ চিন্তায় পড়ে যাই। কারণ ১৯৫২ সালের কোনো প্রেক্ষাপটকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলব, তা আমার জানা ছিল না। পরে খুঁজতে খুঁজতে ওই সময়ের দিকে বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন একটি ছবি পাই। বাবার ছবির আলোকে নিজের মধ্যে ওই সময়ের একটি আবহ দাঁড় করাই। আর সেটি নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি তাতে সম্মতি দেন।’