প্রাইমারি শেষে আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এগোয়নি জাহানারা বেগমের। ধর্মীয় বিধিনিষেধ ছিল। তবে স্কুল-কলেজে না গেলেও বাড়িতে পড়া চালিয়ে গেছেন তিনি। এসএসসির পর তাঁর প্রথম সন্তান ইসমাতের ভাগ্য হতে যাচ্ছিল তারই মতো। পাড়াপড়শিরা সবাই বলেছিলেন, মেয়ের আর লেখাপড়ার দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে দেন। জাহানারা তাদের কথা শোনেননি। মেয়ে ইসমাত আরা এখন এমবিবিএস ডাক্তার। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনোকলজি বিভাগে কাজ করেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বাকি পাঁচ ভাইবোনের সবাই উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত।
আজ রোববার মা দিবসের সকালে মাকে নিয়ে তাঁরা সব ভাইবোন উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী সেন্টার মিলনায়তনে। তাঁদের মা ‘রত্নগর্ভা মা’ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। ৫০ জন রত্নগর্ভা মায়ের মাঝখানে বসে বারবার ভিজে উঠছিল মা জাহানারার চোখ। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ছেলে ফোরকান মাহমুদ বলছিলেন, ‘বাবা জাহাজের মাস্টার ছিলেন। বাবার কথা মনে করে মা আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।’ আজ আনন্দের দিনে চোখে জল কেন? জানতে চাইলে আবারও কেঁদে ফেলেন মা। বলেন, ‘আনন্দে।’ তাঁর অন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে উইং কমান্ডার ফরহাদ হোসেন মাহমুদ র্যাব সদর দপ্তরে কর্মরত, মেয়ে ইফফাত আরা ইনস্যুরেন্স কর্মকর্তা, দিলারা বেগম চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং শাহানা মোহাম্মদ নারী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।
এ রকম বহু সফল মানুষ ও পরিবারের পেছনে থাকেন একজন করে মা। তাঁদের আজ দেওয়া হলো পুরস্কার ‘রত্নগর্ভা মা ২০১৭’। এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘মায়ের ভেতরের বড় গুণ, যোগ্যতা, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্ব সন্তানের ভেতরে প্রবাহিত হয়। এই মায়েদের ভেতর দিয়েই তাঁদের সন্তানেরা আজ সফল হয়েছেন।’
‘রত্নগর্ভা মা ২০১৭’ পুরস্কারের সাধারণ বিভাগে ২৫ জন মাকে এ সম্মানে ভূষিত করা হয়। মায়েরা হলেন ফিরোজা সুলতানা রশীদ, আনোয়ারা বেগম, সুরাইয়া বেগম, মাহবুবা ইসলাম, জাহানারা বেগম, শিরিন সুলতানা, কামরুজ্জামান রেখা, নিলুফার বেগম, বেগম রহিমা ইসলাম, সামছুন্নাহার খানম, শিরিন চৌধুরী, নফছুন নাহার হাবিবা, চেমন আরা বেগম, নুরজাহান বেগম, সখিনা খাতুন, মঞ্জু বিশ্বাস, রহিমা খাতুন চৌধুরী, মমতাজ বেগম, আমেনা আফতাব, দিলওয়ারা বেগম, লায়লা বেগম, সাহিনা কবির নার্গিস, নিলুফার সুলতানা, হোসনে আরা রহমান ও নীলুফার মতিন।
বিশেষ বিভাগে রত্নগর্ভা মায়ের পুরস্কার পান সারোয়ার জাহান লুৎফে আরা রশীদ, লুৎফুন নাহার বেগম, ফেরদৌসী ইসলাম, সাইদা মঞ্জুর, সেলিনা মোহসীন, শাকুরা বেগম, শামসুন নাহার বেগম, রোমানা খাতুন, হালিমা হোসাইন, সৈয়দা মাহমুদা খাতুন, গুলশান আরা বেগম, আতফা বেগম, দেলোয়ারা বেগম, মাহফুজা রহমান খান, প্রতিভা বড়ুয়া, কল্পনা বড়ুয়া, খোরশেদা খানম, হুসনে জাহান, সৈয়দা বিলকিস বানু, হেমলতা দাশ, দিলরুবা আহমেদ, হাজেরা নজরুল, আখতার আরা বেগম, খানম শামসি আহমদ ও শামসুন নাহার বেগম। এ ছাড়া শিল্পী ও গবেষক মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে ‘মাই ড্যাড ওয়ান্ডারফুল’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
পুরস্কার পাওয়া মা ফিরোজা সুলতানা রশীদ বলেন, ‘এ রকম একটা দিন যে আমার জীবনে এসেছে, সেটা আমার জন্য পরম পাওয়া।’ গত মাসে মারা গেছেন বিশেষ বিভাগে পুরস্কার পাওয়া লুৎফুন নাহার বেগম। তাঁর মেজো মেয়ে খন্দকার কোহিনুর আখতার মায়ের পুরস্কার নিতে এসে জানালেন, ‘মা চিঠি পেয়েছিলেন। পুরস্কারটি নিতে হলো আমাকে।’
ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি খায়রুল মজিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাগরিক টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক, সম্মানিত অতিথি শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী, অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস।
রুবানা হক বলেন, ‘মা সংসারের ঝড় সামলান। আমি সামলাচ্ছি। শুরুতে একটি সন্তান হারিয়েছি, তার পর হারিয়েছি স্বামীকে। এখন এই তিন সন্তান না থাকলে আমি মা হতে পারতাম না। হারানোর সঙ্গে যুদ্ধ করে জেতা যায় না, বেঁচে থাকা যায়। ঝড় সামলে মাকে কাজ করে যেতে হয়। এখন আমিই আমার সন্তানদের মা-বাবা দুটিই। নাতির নানা-নানি দুটিই।’
স্বাগত বক্তব্যে পুরস্কারের উদ্যোক্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘খুব অল্প বয়সে আমি মাকে হারিয়েছি। আজ আমার সামনে অনেক মা। উপস্থিত এই মায়েদের ভেতরে আমি নিজের মাকে খুঁজে পাই।’ এ ছাড়া আরও বক্তব্য দেন আবুল কালাম আজাদের মেয়ে অনামিকা আজাদ ও ছেলে জিয়াউর রহমান আজাদ। অনুষ্ঠানে রুমানা ইসলাম ‘মায়ের মতো আপন কেহ নাই’ ও মুস্তাফা জামান আব্বাসী ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গান দুটি গেয়ে শোনান।
২০০৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চশিক্ষিত সন্তানের মায়েদের রত্নগর্ভা মা পুরস্কার দিয়ে আসছে আজাদ প্রোডাক্টস। অনুষ্ঠানে নিজেদের পরিচয় ও মায়ের অবদান নিয়ে কথা বলেন বেশ কয়েকজন কৃতী সন্তান।