প্রতিদিন সকাল যখন দুপুরের দিকে রওনা করে, তখন তিনি একটু ঘুমিয়ে নেন। আজ তাঁর ঘুম আসছিল না। সকাল থেকেই বাড়িতে আসছিল মানুষ। তাতে তিনি খুশিই হচ্ছিলেন। শরীর ভালো নয়। এখনো হাঁটতে গেলে ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হয়। তবে দিনে দিনে সুস্থ হয়ে উঠছেন।
আজ ছিল সংস্কৃতিকর্মী কামাল লোহানীর জন্মদিন। ছিয়াশিতে পড়লেন তিনি। স্মৃতিশক্তি টনটনে। এখনো অনর্গল কথা বলে যেতে পারেন। সন-তারিখ মোটামুটি ঠিক রেখে বলে যেতে পারেন কথা। কথা বলতে খুব ভালো লাগে তাঁর। কিন্তু শরীরের এই অবস্থায় বেশি কথা বলা চিকিৎসকের বারণ। তাই কিছুদিনের জন্য তাঁর টেলিফোন বন্ধ করে (সুইচড অফ) রেখেছিলেন বন্যা লোহানী—কামাল লোহানীর বড় মেয়ে। তাতে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন তা নয়।
বিকেলে যখন ফোন করি, তখনো তাঁর বাড়িতে দর্শনার্থীরা অপেক্ষা করছেন। দীর্ঘ দিন তাঁকে ক্লান্ত করেছিল, তাই তিনি কিছুক্ষণের জন্য ঘুমাতে গেছেন। বন্যা লোহানী বললেন, আজ তাঁর খুব ভালো লাগছে। মাঝেমাঝেই জিজ্ঞেস করছেন, ‘ও এসেছিল? কেন আসেনি?’ মেয়ে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘এই যানজট ঠেলে সবাইকে আসতে হবে কেন? যদি চাও ফোন করতে পারি।’ তাতে কিছুটা শান্ত হয় তাঁর মন।
এখন ফোন খুলে দেওয়া হয়েছে। ফোন এলে কথা বলেন। ভালোই লাগে।
২.
কামাল লোহানী—সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী। এ দেশের ঐতিহাসিক নানা ঘটনার সঙ্গে রয়েছে তাঁর যুক্ততা। ১৯৬১ সালে অন্য অনেকের সঙ্গে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে তাঁরও ছিল দৃঢ় ভূমিকা।
তাঁর সম্পর্কে অল্প কিছু বলা যাক। তাঁর পুরো নাম কিন্তু আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। তাঁর জন্ম সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন। মা হারান ৬-৭ বছর বয়সে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্য দিয়ে স্কুলজীবন শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। ভাষা আন্দোলনের বছর পাস করেন মাধ্যমিক পরীক্ষা। সে সময় থেকেই রাজনীতিকে পেলেন বন্ধু হিসেবে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তিনি প্রচলিত শিক্ষার ইতি টানেন। রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চায় এরপর ঢেলে দেন মন।
প্রথম গ্রেপ্তার হন ১৯৫৩ সালে। সে সময় পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সময় অন্য নেতাদের সঙ্গে নুরুল আমিনও এসেছিলেন। তাঁর আগমনের প্রতিবাদে যে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী বিক্ষোভ করেন, তাঁদের একজন ছিলেন কামাল লোহানী। পাবনার রাজনৈতিক নেতা, এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি গ্রেপ্তার হন। এরপর একাধিকবার তাঁর জায়গা হয় জেলখানায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২-(ক) ধারা দিয়ে পূর্ববাংলায় ‘গভর্নরের শাসন’ চালু করার পর আবার ধরপাকড় শুরু হয়। এ সময় গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে ছাড়া পান। বাড়িতে পড়াশোনা নিয়ে মতবিরোধ হয়। ছোট চাচা তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে ১৫ টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। তিনি তত দিনে মার্ক্সবাদের অনুসারী হয়ে উঠেছেন। শুরু হয় সাংবাদিকতার জীবন। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকায়। চাকরি পেতে সহযোগিতা করেন চাচাতো ভাই ফজলে লোহানী। এ বছরই তিনি ন্যাপে যোগ দেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হলে তিনি আত্মগোপনে যান।
এর কিছুদিন পর থেকেই নাচের প্রতি আগ্রহ জন্মে কামাল লোহানীর। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির হয়ে কামাল লোহানীর নৃত্যগুরু জি এ মান্নান ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ প্রযোজনা করলে কামাল লোহানী তাতে অংশ নেন। পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে তিনি যান।
ছায়ানট, উদীচী, ক্রান্তিসহ বহু সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তিনি। ষাটের দশক থেকে রাজনীতি আর সংস্কৃতি যখন পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলেছিল, তখন তিনি ছিলেন সেই বন্ধনের একজন রূপকার।
৩.
চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীকে ১৯৬০ সালে বিয়ে করলেন কামাল লোহানী। তাঁদের এক ছেলে দুই মেয়ে—সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী।
পাকিস্তান আমলে তিনি এরপর চাকরি করেন দৈনিক ‘আজাদ’, দৈনিক ‘সংবাদ’, ‘পূর্বদেশে’।
১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট' সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি' নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬৭ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্বোধন হয় ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। আয়োজন করেন গণসংগীতের অনুষ্ঠান ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’। নাটক ‘আলোর পথযাত্রী’ পরিচালনা ও এতে অভিনয় করেন কামাল লোহানী। নৃত্যনাট্য ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে’ বিবেকের ভূমিকায় নেচেছিলেন তিনি। আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে বজ্রসেন হিসেবে তাঁর ছবিটি।
৪.
মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঢাকা বেতারের। ১৯৭৩ সালে ‘দৈনিক জনপদ’ নামে একটি নতুন পত্রিকায় যোগ দিয়ে আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৭৪ সালে ‘বঙ্গবার্তা’, এরপর ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র নির্বাহী সম্পাদক হন। ১৯৭৮ সালে তাঁকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হলে ‘দৈনিক বার্তা’ছেড়ে ‘বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট’ এ যোগ দেন। ১৯৯১ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ষোলো মাসের মাথায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন। ২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
৫.
আজ বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর বসার ঘরেই ছিলেন। টেলিভিশন চ্যানেলের লোকজন এসেছিলেন, এসেছিলেন অনেকে শুভেচ্ছা জানাতে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। গুমোট দিনে গরমের মধ্যে বসে থাকা খুবই কঠিন। তারপরও হাসিমুখে সবাইকে সময় দিয়েছেন।
রাত নয়টার দিকে ফিরে এসেছেন শোয়ার ঘরে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন লাগছে আজকের দিনটায়? ৮৬ বছর বয়সেও তো আপনাকে যুবক মনে হয়!’
মৃদু হেসে বললেন, ‘এবারের অসুখটা আমাকে কাহিল করে দিয়েছে।’
‘বন্যাদি বললেন, একটু সুস্থ হলেই আপনার পায়ের ভারসাম্য ফিরে আসবে।’
‘হ্যাঁ, আসবে বোধ হয়।’
এরপর তিনি জানতে চাইলেন আমাদের পরিবারের কথা, ধরে ধরে প্রত্যেকে কে কেমন আছে জানতে চাইলেন।
ফোন ছেড়ে ভাবতে বসলাম, এ রকম মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। অসুস্থ শরীরে নিজের এই বয়সেও তিনি নিজের মতো করে জানতে চাইছেন অন্যদের কুশল।
শুভ জন্মদিন, কামাল লোহানী।
আপনি ভালো থাকুন। জন্মদিনে আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।