শিল্পের আবেদন সীমাহীন ও চিরন্তন: রাষ্ট্রপতি

জাতীয় নাট্যশালায় ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
জাতীয় নাট্যশালায় ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

শিল্পকর্ম ও শৈল্পিক ভাবনা ব্যক্তিশিল্পীর হলেও তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের ব্যাপ্তি সর্বত্র এবং তা সর্বজনীন। তাই নিজেদের শিল্পকর্মে জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টি তুলে ধরতে শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘শিল্পী নিজস্ব চেতনা, পারিপার্শ্বিকতা তথা স্থান-কাল-পাত্রকে ধারণ করে তা ফুটিয়ে তোলেন তাঁর শিল্পকর্মে। তাই দেশ-কাল-সংস্কৃতি ভেদে শিল্পীর স্বরূপ ও কর্মকাণ্ড ভিন্নতর হতে পারে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, শিল্পের নান্দনিকতা ও আবেদন সীমাহীন ও চিরন্তন। প্রতিটি শিল্পকর্মে ফুটে ওঠে শিল্পীর নিজস্ব চিন্তা-চেতনার পাশাপাশি জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। তাই শিল্পকর্ম ও শৈল্পিক ভাবনা ব্যক্তিশিল্পীর হলেও তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের ব্যাপ্তি সর্বত্র এবং তা সর্বজনীন।’

আজ শনিবার বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ৬৮ দেশের চারুশিল্পীরা অংশ নিচ্ছেন মাসব্যাপী এ প্রদর্শনীতে। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি এই চিত্রকলার প্রদর্শনী উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেন। পরে রাষ্ট্রপতি তিনজন শিল্পীকে গ্র্যান্ড পুরস্কার এবং ছয়জন শিল্পীকে সম্মানসূচক পুরস্কার তুলে দেন। এবার দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্র্যান্ড পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পী আতিয়া ইসলাম, সালমা জাকির বৃষ্টি ও ভারতের কুনড্যাং জি। সম্মানসূচক পুরস্কার পাওয়া শিল্পীরা হচ্ছেন বাংলাদেশের কামরুজ্জামান স্বাধীন, ফকরুল ইসলাম মজুমদার ও নাজমুন নাহার কেয়া; চীনের উ জুন, ফিলিস্তিনের মোনতাহের জাওয়াব্রে ও থাইল্যান্ডের ত্রিরাত স্রিবুরিন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং সম্মানিত অতিথি ছিলেন এবারের প্রদর্শনীর পর্যবেক্ষক ইমেরিটাস অধ্যাপক তেতসুইয়া নোদা। পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন বিচারকমণ্ডলীর প্রধান শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। সংস্কৃতিসচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘জাতি গঠনেও শিল্প-সংস্কৃতির ভূমিকা অপরিসীম। বাঙালি জাতির অর্জনের পেছনে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের রয়েছে অসামান্য অবদান। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের পথ ধরে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে এ দেশের শিল্পীসমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রামসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এ দেশের শিল্পীসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। জাতির যেকোনো প্রয়োজনে বা সংকটময় মুহূর্তে সংস্কৃতিকর্মীরা সব সময় সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। অর্জন করেছে দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।’

রাষ্ট্রপতি বলেন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণেও শিল্প-সংস্কৃতি অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। একটি জাতির তরুণ ও যুবসমাজের মাঝে শৃঙ্খলা, জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেমের চেতনা বিকাশসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য জাগিয়ে তুলতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশে-দেশে, মানুষে-মানুষে মৈত্রীর বন্ধন ও সম্পর্কের উন্নয়নে শিল্পকলার অবদান ব্যাপক। শিল্পকলা একটি দেশ ও জাতিকে বিশ্ব মানচিত্রে গৌরব ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারে।

সংস্কৃতিকে জীবনের দর্পণ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘যে জাতির শিল্প-সংস্কৃতি যত বেশি সমৃদ্ধ, সে জাতি তত বেশি উন্নত। সুজলা-সুফলা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। ঐতিহ্যগতভাবেই এ দেশের মানুষ শিল্প ও সংস্কৃতিমনা। এ দেশের কবি, গায়ক ও শিল্পীরা অনেকেই দীক্ষা লাভ করেছেন বাংলার অপরূপ প্রকৃতি ও উদার সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে। তাঁরা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন মেধা ও মননে এবং তুলে ধরেছেন দেশের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে।’

প্রদর্শনীর সফলতা কামনা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী দেশ-বিদেশের শিল্পীদের মধ্যে মত ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক শক্তিশালী ও কার্যকর প্ল্যাটফর্ম। এ আয়োজন চারুশিল্পের নান্দনিকতায় যোগ করবে নতুন মাত্রা। প্রদর্শনীর শিল্পনৈপুণ্য আগত শিল্পী ও দর্শকদের যেমন উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে, তেমনি উন্মেষ ঘটাবে বর্ণাঢ্য শিল্পসত্তার।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

উদ্বোধনের পর প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন রাষ্ট্রপতি

সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে শিল্পরসিকেরা বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চিত্রশালার ছয়টি গ্যালারিতে অবলোকন করতে পারবেন এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর শিল্পকর্মসমূহ। ২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রদর্শনী চলবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

এবারের আয়োজনে ২৬৬ জন বিদেশি শিল্পীর মধ্যে ২২৩ জন শিল্পী প্রতিযোগিতায় শিল্পকর্ম জমা দিয়েছেন, ২৯ জন বিদেশি শিল্পী বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নিচ্ছেন এবং ১৪ জন পারফরম্যান্স আর্টিস্ট এবার তাঁদের শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শন করছেন। এতে ১৯৯ জন বাংলাদেশি শিল্পীর মধ্যে ১০৭ জন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, ১৩ জন মাস্টার পেইন্টারের প্রদর্শনী থাকছে, বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নিচ্ছেন ৬৩ জন শিল্পী এবং ১৬ জন দেশীয় পারফরম্যান্স আর্টিস্ট তাঁদের শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শন করছেন। এই মেগা প্রদর্শনীতে দেশীয় শিল্পীদের ২০৩টি আর্টওয়ার্কের এক বিরাট শিল্পযজ্ঞ পরিবেশিত হচ্ছে।

এবারের আয়োজনের মধ্যে থাকছে দেশি-বিদেশি শিল্পীদের মোট ৩৬৮টি পেইন্টিং, প্রিন্ট ও ফটোগ্রাফি; ৩৩টি ভাস্কর্য; ৫২টি ইনস্টলেশন আর্ট এবং ৩০ জন পারফরম্যান্স আর্টিস্টের শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শনী। ১২ জন বাংলাদেশি নবীন শিল্পীর অংশগ্রহণে এবং শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামীর তত্ত্বাবধানে ‘ইয়াং আর্ট প্রজেক্ট’ শীর্ষক বিশেষ কার্যক্রম। দেশি-বিদেশি ৪৬৫ জন শিল্পীর ৫৮৩টি শিল্পকর্মের এ বিশাল শিল্পযজ্ঞে থাকছে আন্তর্জাতিক সেমিনার, পেইন্টিং, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, প্রাচ্যকলা, প্রিন্ট মেকিং, ভিডিও আর্ট, মৃৎশিল্প, পারফরম্যান্স আর্ট, নিউ মিডিয়া এবং স্থাপনা শিল্প। রয়েছে কারুপণ্য মেলা, ফুড কোর্ট, আর্ট ক্যাফে, শিশু কর্নার, আর্ট ক্যাম্প, পারফরম্যান্স আর্ট ওয়ার্কশপের আয়োজনও।