ল্যাম্পপোস্ট থেকে গুলশানে ডুপ্লেক্স, উত্তরায় কমপ্লেক্স

রাজ্জাক (জন্ম: ২৩ জানুয়ারি ১৯৪২, মৃত্যু: ২১ আগস্ট ২০১৭)
রাজ্জাক (জন্ম: ২৩ জানুয়ারি ১৯৪২, মৃত্যু: ২১ আগস্ট ২০১৭)

রাজলক্ষ্মী নামেন, রাজলক্ষ্মী। বিমানবন্দর পেরিয়ে সামনে খানিকটা যাওয়ার পর বাসচালকের সহকারী যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। গতকাল মঙ্গলবার ভরদুপুরে সেখানে নেমে চোখে পড়ল চিত্রনায়কের স্মৃতিবিজড়িত বিশাল বিপণিবিতানটি—রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো নাম না হয়েও এই জায়গার নামই হয়ে গেছে রাজলক্ষ্মী।

সুবিশাল ভবনের ঠিক ওপরে তাকাতেই ভবনের নামফলকটি নজরে এল। খুব সুন্দর একটি লোগো, কিছু অন্য রকম। প্রথম দেখায় চোখে পড়ে এর বৈশিষ্ট্য। ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন মানুষ বসে আছে, পাশেই একটা ডাস্টবিন—লোগোটা এমন। গতকাল দুপুরের ভবনের ওপরের ফ্লোরে প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত কার্যালয়ে প্রয়াত নায়কের দুই ছেলের সঙ্গে দেখা। বাপ্পারাজ ও সম্রাট।

আজ বুধবার রাজ্জাকের চলে যাওয়ার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই দিনকে স্মরণ করে কিছু লেখার আশায় সেখানে যাওয়া। রাজ্জাকের রাজ্জাক হয়ে ওঠার প্রায় সব গল্পই তো জানা। সেই গল্পগুলোই আবার নতুন করে জানতে চাই। রাজ্জাক বলে কথা, তিনি তো একজনই।

শুরুতে বাপ্পারাজ জানালেন, দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী একেবারেই ঘরোয়াভাবে নিজেদের উদ্যোগে গুলশানের বাসায় পালন করবেন। শিল্পী সমিতির উদ্যোগে এফডিসিতে একটি স্মরণ অনুষ্ঠান করার কথা। বাসার আয়োজনের সঙ্গে সময় মিললে সেখানেও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে অংশ নেবেন বাপ্পারাজ।

রাজ্জাকের সব প্রতিষ্ঠানের লোগোতে আছে ল্যাম্পপোস্টটি

কথা হয় শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাজ্জাক ভাই শুধু আমাদের শিল্পী নন, তিনি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণাও। তিনি আমাদের সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সকালে রাজ্জাকের কবরে ফুল দেওয়া হয়েছে। আসরের নামাজের পর রাজ্জাক ভাইয়ের স্মরণে দোয়া ও শোকসভার আয়োজন করা হবে।’

কথায় কথায় বাপ্পারাজই জানিয়েছেন তাঁদের প্রতিষ্ঠানের বিশেষ লোগোটির কথা। বাবার মতো অমায়িক তাঁর দুই ছেলে। জীবদ্দশায় নায়ক রাজ্জাক তাঁর ফেলে আসার জীবনের কথা অবলীলায় বলতেন, গর্ববোধ করতেন। ছেলে জানালেন বাবার সেই গৌরবগাথা। একটি পুরোনো প্যাড আনালেন অফিসের এক কর্মীকে দিয়ে। যেখানে লেখা, রাজলক্ষ্মী টেলিফিল্মস, ৭৪ কাকরাইল। মিলল আরেকটি পুরোনো প্যাড। রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন, ৬৪ বিজয়নগর...। দুটি প্যাডের প্রতিষ্ঠানের নামের পাশেই সেই লোগোটা, ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন মানুষ বসে আছে, পাশেই একটা ডাস্টবিন।

রাজ্জাকের গড়া উত্তরার রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স। ছবি: মাসুম আলী

প্রথম আলোর কাছে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বাপ্পারাজ বলেন, ‘এটা প্রতীকী। ১৯৬৪ সালে বাবা শূন্য থেকে জীবন শুরু করেছিলেন। তখন আমার বয়স আট মাস মাত্র। আমার নিজের মনে নেই প্রথম দিকের কথা। বাবার কাছে শুনেছি। ১৯৬৪ সালের আগে বাবা কখনো ঢাকায় আসেননি। কারও বাসায় উঠবেন—এমন পরিচিতজনও ছিল না। কপর্দকহীন হয়ে ঢাকা এসে আমাদের নিয়ে স্টেডিয়াম এলাকার একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে ছিলেন। সেখান থেকে শুরু। এই ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকেই ঢাকায়, বাংলাদেশে বাবার নতুন জীবন শুরু। আমাদের নতুন শুরু। এ বিষয়টিকে প্রতীকী অর্থে বোঝানো হয়েছে লোগোটিতে।’

বাপ্পারাজ বলেন, ‘আব্বা যখন প্রথম রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের যাত্রা করেন, তখন এই লোগোটা করা হয়। বাবার পরিকল্পনামতো এটার নকশা করেছিলেন সুভাষ দত্ত। আমাদের সব কটি প্রতিষ্ঠানে, সাইনবোর্ডে, প্যাডে এই লোগো ব্যবহার করা হয়েছে।’

শিল্পীসত্তা লুকিয়ে ছিল তাঁর মনের ভেতরেই

জীবনটাই ছিল সিনেমার গল্পের মতো
লোগোর সূত্রেই সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতোই মনে পড়তে লাগল রাজ্জাকের অতীতের কথাগুলো। তাঁর বলা গল্পগুলো। তিনি বলতেন, ‘আমার জীবনটাই একটা সিনেমা...।’ নানা সময়ের সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, একটা সময় ফার্মগেট এলাকায় থিতু হয়েছিলেন দুই বাচ্চা আর স্ত্রী লক্ষ্মীকে নিয়ে। তখন জীবিকা নির্বাহের জন্য টিভি নাটকে অভিনয় করতেন। নাটকে অভিনয় করে সপ্তায় পেতেন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। মাসের খরচ ৬০০ টাকা। রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘অল্প আয়ে সংসারের খরচ চলে না। বাচ্চাদের দুধ জোগাড় করতেই সব টাকা ব্যয় হয়ে যেত। ওই সময় স্বামী-স্ত্রী দুজন মাঝেমধ্যে উপোসও করতাম। পয়সার অভাবে ফার্মগেট থেকে ডিআইটি টিভি কেন্দ্রে হেঁটে যাতায়াত করতাম।’

একবার রাজ্জাকের মুখে তাঁর জীবনের গল্পটা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। ২০১৬ সালে। এফডিসিতে এসেছিলেন রাজ্জাক। সেদিন ছিল তাঁর জন্মদিন উদ্‌যাপনের আয়োজন। অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন। এই প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অকপটে জানিয়েছিলেন নিজের এক জীবনের কথা। সেদিন রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘সকলের ভালোবাসা পেয়ে আজ আমি পরিপূর্ণ। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেক সময় অর্ধাহারে দিন কেটেছে আমার। সপ্তাহে ৬৫ টাকা পেতাম টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করে, সেই ৬৫ টাকা দিয়ে আমার সংসার চলেছে। একটা সময় পর আমি “বেহুলা”র নায়ক হলাম। ৫০০ টাকা সাইনিং মানি নিয়ে খুশিতে বাড়ি এলাম। তারপরের কাহিনিটা অনেকেই জানেন।’ সেদিন কথা বলার এক ফাঁকে বারবার কেঁদেছিলেন তিনি। অশ্রুসিক্ত রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘আজকে আমি এই যে নায়করাজ, এটা আমার একার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ...আমার যাঁরা শ্রদ্ধেয় পরিচালক ছিলেন, তাঁরা আমাকে এবং তিনজন নায়িকা নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেই যুদ্ধে আমি একজন সৈনিক হিসেবে কাজ করেছি তাঁদের সঙ্গে। শুধু রোববার দিন বাড়ি যেতাম আমি, অন্য দিনগুলোয় মেকআপ রুমের ফ্লোরে শুয়ে থাকতাম।’ তাঁর সঙ্গে সেদিন মিলনায়তনের উপস্থিত অনেকেই কেঁদেছিলেন।

২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি লক্ষ্মীকুঞ্জের আঙিনায়। পরদিন ছিল তাঁর ৬৯তম জন্মদিন। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া


এক্সট্রা থেকে নায়ক
সেই নায়ক রাজ্জাকের অভিনয়জীবনের শুরুটা হয়েছিল একেবারেই ছোট চরিত্রের অভিনয়ের মাধ্যমে। সিনেমা দুনিয়া যাকে বলে ‘এক্সট্রা’। কলেজে পড়ার সময় চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান। অজিত ব্যানার্জির ১৯৫৮ সালের ছবি ‘রতন লাল বাঙালি’। ওই ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আশিস কুমার ও নায়িকা সন্ধ্যা রায়। ছোট্ট একটি চরিত্র ছিল রাজ্জাকের—পকেটমার।

রাজ্জাকের দ্বিতীয় ছবি ‘পঙ্ক তিলক’। পরিচালনা করেছেন মঙ্গল চক্রবর্তী। ওই ছবিতে ছাত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন। একজন ছাত্র হিসেবে ক্লাসে আসা-যাওয়া, দু-একটা সংলাপ—এই ছিল রাজ্জাকের উপস্থিতি। তৃতীয় ছবি ‘শিলালিপি’। এখানেও তাঁর চরিত্রটি ছিল সে অর্থে নগণ্য। একটি গানের দৃশ্যে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেব অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য এবার সম্মানী পেয়েছেন। ২০ টাকা। আগের দুটি ছবিতে ‘এক্সট্রা’র ভূমিকায় অভিনয় করে আদৌ কোনো পারিশ্রমিক বা সম্মানী পেয়েছিলেন কি না, জানা যায় না। তৃতীয় ছবি ‘শিলালিপি’র ২০ টাকার সম্মানী রাজ্জাকের আস্থা আর উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন, টালিগঞ্জে (পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রশিল্পের মূল কেন্দ্র) সুবিধা করতে পারবেন না। ‘এক্সট্রা’ হয়েই থাকতে হবে। নিলেন নতুন চ্যালেঞ্জ। চলে গেলেন মুম্বাই (তখনকার বোম্বে)।

বাংলা ছবিতে নতুন প্রাণ এনে দিয়েছিলেন রাজ্জাক

১৯৫৯ সালের কথা। কলকাতার ছেলে রাজ্জাক মুম্বাই এসেছেন অভিনয় শিখতে। নায়ক হতে চান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন অভিনয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ফিল্মালয়’-এ। তখন ওখানে ক্লাস নিতেন দিলীপ কুমার, শশধর মুখার্জিরা। ওখানে এক বছরের কোর্স। কিন্তু রাজ্জাক বরাবরই অস্থির ছিলেন। তাত্ত্বিক, পদ্ধতিগত শিক্ষা রাজ্জাকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। বোম্বের চিত্রজগতে ঢোকার সুযোগ খুঁজতে থাকেন, কিন্তু বিষয়টি কঠিন নয়, অসম্ভবই ছিল। কলকাতায় ফিরে আসেন রাজ্জাক।

ইতিমধ্যে বিয়ে করে কিছুটা থিতু হন। কিন্তু এর মধ্যে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা থেকে দলে দলে মুসলিমরা পাড়ি দেয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। রাজ্জাকও স্ত্রী লক্ষ্মী ও শিশুপুত্র বাপ্পাকে নিয়ে ওই দাঙ্গার সময় ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল রাজ্জাক ঢাকা পৌঁছান। নায়ক হওয়ার বাসনা নিয়ে ঘুরে বেড়ান ছবিপাড়ায়।

ক্যারিয়ারের শুরুতে করেছেন সংগ্রাম

একদিন পর্দার সামনে থাকার একটা সুযোগ এল। সেটা ১৯৬৫ সালে, ‘আখেরি স্টেশন’ ছবিতে সহকারী স্টেশনমাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ঢাকার ছবিতে ওটিই রাজ্জাকের প্রথম অভিনয়। এরপর আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন। যেমন ‘কার বউ’ ছবিতে অটোরিকশাচালক (বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার), ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’-এ পাড়ার ছেলে মিন্টু, ‘ডাকবাবু’তে আদালতের কর্মচারী, ‘কাগজের নৌকা’য় বাইজিবাড়ির মাতাল। একসময় পরিচয় হয় জহির রায়হানের সঙ্গে। তিনি রাজ্জাককে ‘বেহুলা’ ছবিতে নেন। ওই ছবি সাইনিং মানি হিসেবে ৫০০ টাকা নগদ পেয়েছিলেন। সেই টাকার কিছু অংশ সংসারের কাজে খরচ হয়। বাকি টাকা বন্ধুবান্ধবকে মিষ্টি খাইয়ে শেষ করেন রাজ্জাক।

জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবিতে সাইনিং মানি হিসেবে ৫০০ টাকা নগদ পেয়েছিলেন।

ছবিটি তখন দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দর্শক সানন্দে গ্রহণ করে নেয় রাজ্জাককে। ‘বেহুলা’ ছবিটি করার পর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাক। এক্সট্রার ভূমিকায়, আউট অব ফোকাসে অখ্যাত-অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করেও একসময় হিরো হয়ে ওঠা যায়! রাজ্জাক প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।

দুই সন্তান বাপ্পারাজ ও সম্রাটের সঙ্গে রাজ্জাক

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া তেমন করেননি। ব্যবসা, চাকরি—কোথাও থিতু হননি। এর একটাই কারণ—নায়ক হতে চেয়েছিলেন রাজ্জাক। ঢাকায় এসে সেই ল্যাম্পপোস্টের পাশে আশ্রয় নেওয়া রাজ্জাক একসময় উত্তরায় বাণিজ্যিক ভবন, গুলশানে বাড়ি করেছেন। এ অর্জন মোটেও আলাউদ্দিনের চেরাগে ঘষে হয়নি। নিজের মেধা, প্রতিভার সবটুকু ঢেলে দিয়ে পরিশ্রম করে তিলে তিলে তৈরি করেছেন। বছরে পর বছর লেগে ছিলেন। একজন এক্সট্রা থেকে হয়েছেন নায়ক, ঢাকাই চলচ্চিত্রশিল্পের রাজা। হয়েছিলেন নায়করাজ। শুধু অভিনয়ের জন্য জীবনে যত ঝড়ঝাপটা আসুক, নিজের স্বপ্নটাকে হারিয়ে যেতে দেননি।