‘চাঁদনী’ ছবির চাঁদনীর কথা নিশ্চয় মনে আছে। ১৯৯১ সালে এহতেশাম পরিচালিত সেই ছবিতে চাঁদনী চরিত্রে অভিনয় করেই রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন শাবনাজ। ১৪ বছর ধরে তিনি নেই চলচ্চিত্রে। স্বামী, সন্তান আর সংসার নিয়েই ব্যস্ত। থাকেন ঢাকার উত্তরায়। বড় মেয়ে নামিরা কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট মেয়েটিরও সেখানে পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। করোনা পরিস্থিতি সব ওলটপালট করে দিয়েছে। স্বাভাবিক হলে ছোট মেয়েকেও পাঠিয়ে দেবেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় শাবনাজের সঙ্গে। জানালেন, তাঁরা যে রোডে থাকেন, সেখানে কারও সংক্রমণের খবর পাননি। শুধু তা-ই নয়, পরিচিত এবং আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে এখনো কেউ করোনা সংক্রমিত হননি, তাই স্বস্তি। তবে দেশে করোনার যে পরিস্থিতি, তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন তিনি।
চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়া নাটকেও অভিনয় করেছিলেন শাবনাজ। দুটো মাধ্যম থেকেই এখন আড়ালে তিনি। আড়ালে থাকা শাবনাজের হঠাৎ দেখা মেলে চলচ্চিত্র কিংবা নাটকসংশ্লিষ্ট কিছু ঘরোয়া আয়োজনে। নিজেকে এখন একেবারে অন্য এক জীবনের বাসিন্দা করে রেখেছেন, যে জীবনে সংসার, স্বামী ও সন্তান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে চান না।
চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে সহশিল্পী, সে সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক নাঈমের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। কথায় কথায় জানালেন ‘বিষের বাঁশি’ ছবির কাজ করতে গিয়ে দুজনের প্রেমের শুরু। আর ‘লাভ’ ছবির কাজ করতে গিয়ে ভালোবাসা বাড়তে থাকে। তবে শুরুতে কেউ কাউকে নিজেদের ভালো লাগার বিষয়টি বুঝতে দিতে চাইতেন না। শাবনাজ বলেন, ‘নাঈমের জন্য মেয়েরা তো অনেক পাগল ছিল। আমি বুঝতে পারতাম। তবে আমার যে ওকে ভালো লাগত, তা বুঝতে দিতাম না। দেখতে তো আমিও কম সুন্দরী ছিলাম না (হাসি)। আমিও ভাব নিয়ে থাকতাম। সে কথা না বললেও আমিও বলব না—এমনটাই ছিল হাবভাব।’
ছবিতে অভিনয়ের তিন বছরের মাথায় শাবনাজ ও নাঈম দুজনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ৫ অক্টোবর, ১৯৯৪ সালে তাঁরা ভালোবেসে বিয়ে করেন। বিয়ের পর দুই বছর ছবিতে অভিনয় করেন শাবনাজ। এদিকে দুজনের বিয়ের পর নাঈমের বাবা মারা যান। এতে ভীষণ ভেঙে পড়েন নাঈম। এই সময়টায় শাবনাজকে স্বামীর পাশে থাকতে হতো সবচেয়ে বেশি। শাবনাজ বললেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই ময়না, ময়না (শাবনাজকে ময়না বলে ডাকেন নাঈম) বলে ডাকাডাকি করে অস্থির করে ফেলত নাঈম। আমাকে ওর সামনে বসে থাকতে হতো। আমার সঙ্গটা তখন ওর বেশি দরকারও ছিল। আমরা অনেক গল্প করতাম, আড্ডা দিতাম। নাঈম কাজও কমিয়ে দেয়। আমিও হাতে থাকা কিছু ছবির কাজ করে নিজেকে গুটিয়ে নিই।’
‘বিষের বাঁশি’ নামের ছবিতে শাবনাজের চরিত্রের নাম ছিল ময়না। আর এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে দুজনের প্রেমের শুরু, তাই শাবনাজকে এই নামেই ডাকা শুরু করেন নাঈম। শাবনাজ বললেন, ‘যেহেতু আমাদের প্রেমের শুরু এই ছবিতে, তাই নাঈম আমাকে ওই নামে ডাকে। এখনো ওই নামে সে আমাকে ডাকে।’
১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত একটানা অভিনয়জীবনে ২৬টি ছবিতে অভিনয় করেছেন শাবনাজ। ‘চাঁদনী’ ছাড়া অন্য ছবিগুলো হচ্ছে ‘দিল’, ‘জিদ’, ‘আনজুমান’, ‘লাভ’, ‘চোখে চোখে’, ‘টাকার অহংকার’, ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’, ‘সোনিয়া’, ‘অনুতপ্ত’। নাঈম ছাড়াও ইলিয়াস কাঞ্চন, বাপ্পারাজ, সালমান শাহ, অমিত হাসান, মান্নারা ছিলেন তাঁরা সহশিল্পী।
শাবনাজ অভিনীত বেশির ভাগ ছবিই ছিল প্রেমের গল্পের। মনে মনে শাবনাজ বৈচিত্র্যময় গল্পের খোঁজে ছিলেন। কিন্তু কেউ শিল্পীর মন বুঝতে পারেননি। তাই আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকেন। শাবনাজ বললেন, ‘একঘেয়ে গল্প। সবই প্রেমের। আমি শুধু নায়িকা হয়ে থাকতে চাইনি। শিল্পী হতে চেয়েছি। তাই বৈচিত্র্যময় গল্প খুঁজছিলাম। পাইনি। একজন অভিনয়শিল্পী মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন অসাধারণ চরিত্র হয়ে।’
১৯৯১ সালে শাবনাজের যখন বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে, তখন তিনি মিরপুর শাহ আলী স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন। মা খুব একটা পছন্দ না করলেও নাট্যকর্মী বাবা উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যা করবে, সৎভাবে করবে, ভালোবেসে করবে।’ শাবনাজ বললেন, ‘পুরান ঢাকায় আব্বার ফুফাতো বোনের গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আব্বার ফুফার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন এহতেশাম সাহেব। বিয়ের চার মাস পর ওই অনুষ্ঠানেরই ভিডিওতে এহতেশাম সাহেব আমাকে দেখেন। পছন্দ করেন। তাঁর ছবির নায়িকা বানানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। বাবাকে তিনি বললেন আমাকে “চাঁদনী” ছবির নায়িকা করতে চান। বাবা যেহেতু মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই তিনি না করলেন না।’
স্কুলে পড়ার সময় শাবনাজও পাশাপাশি ভিন্ন কিছু মনে মনে খুঁজছিলেন। স্কুলে অঙ্ক ছাড়া কোনো বিষয় তাঁর ভালো লাগত না। বললেন, ‘আমি সায়েন্সে পড়তাম। জেনারেল ম্যাথ ও হায়ার ম্যাথে বরাবরই আমি ৯৫–এর ওপরে নম্বর পেতাম। অন্য বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ পেতাম না।’ এসএসসির পর হঠাৎ চলচ্চিত্রের সুযোগ পেয়ে গেলে তাই কিছুটা খুশিও হন।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই জীবনের প্রথম সিনেমায় কাজ শুরু করেন শাবনাজ। তারকা হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। প্রথম ছবি ‘চাঁদনী’ তাঁকে চলচ্চিত্রের ব্যস্ত তারকা বানিয়ে দেয়। প্রথম ছবিতে সম্মানী পেয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকা। জনপ্রিয়তার কারণে দ্বিতীয় ছবিতেই সম্মানী বাড়িয়ে দেন ৬ গুণ। এদিকে প্রথম ছবির জনপ্রিয়তায় পরের বছরের পুরো সময়টা বুকিং করে নেন প্রযোজক-পরিচালকেরা।
নব্বইয়ের দশকের আলোচিত সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’–এও অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন শাবনাজ ও নাঈম। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান সম্মানীও দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু পরে ছবিটিতে আর তাঁদের কাজ করা হয়নি। এরপর ছবিটির মধ্য দিয়ে সালমান শাহ ও মৌসুমীর মতো দুজন নায়ক-নায়িকাকে পায় বাংলাদেশ।
একটানা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন শাবনাজ। ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ছিল টানা কাজ করার সময়কার সর্বশেষ ছবি। এরপর আর কোনো কাজ করেননি। সংসারে নিজেকে মনোযোগী করেছেন। ১৯৯৯ সালে এসে একসময়ের জনপ্রিয় এই নায়িকার অভিষেক ঘটে টেলিভিশন নাটকে। প্রথম নাটক ‘আকাস কুসুম’। এরপর আরও কয়েকটি নাটকে অভিনয় করা হয় তাঁর। ২০০৫ সালে দীর্ঘ বিরতির পর আবার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অনুরোধ আসে শাবনাজের কাছে। বরেণ্য অভিনয়শিল্পী এ টি এম শামসুজ্জামানের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে আজিজুর রহমানের ‘ডাক্তার বাড়ি’ ছবিতে অভিনয় করেন। এরপর আর ছোট পর্দা আর বড় পর্দা কোথাও দেখা যায়নি তাঁকে। এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপও নেই। পেছন ফিরে তাকাতেও চান না।