যুদ্ধ করেই নারীকে এগোতে হয়

কখনো মনীষা কৈরালা (বাঁয়ে), কখনো নন্দিতা দাস—দর্শকের সামনে অকপটে বলে গেছেন জীবনের গল্প। গতকাল বাংলা একাডেমিতে, ঢাকা লিট ফেস্টের অধিবেশনে। ছবি: প্রথম আলো
কখনো মনীষা কৈরালা (বাঁয়ে), কখনো নন্দিতা দাস—দর্শকের সামনে অকপটে বলে গেছেন জীবনের গল্প। গতকাল বাংলা একাডেমিতে, ঢাকা লিট ফেস্টের অধিবেশনে।  ছবি: প্রথম আলো

মিলনায়তনের ভেতরে দাঁড়ানোরও জায়গা নেই, ঢোকার মুখেই স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য দর্শকদের ঠেকানো যায়নি। মনীষা কৈরালা ও নন্দিতা দাস কীভাবে গতানুগতিকতার বাইরে এসে জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সে গল্প তাঁরা শুনেছেন দাঁড়িয়ে কিংবা মেঝেতে বসেই।

বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে গতকাল শুক্রবার সকালে লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে ‘ব্রেকিং ব্যাড’ (প্রথাগত গণ্ডি ভেঙে কথা বলা) অধিবেশনের আলোচক ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা এবং অভিনেত্রী ও পরিচালক নন্দিতা দাস। সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা লিট ফেস্টের অন্যতম পরিচালক সাদাফ সায্।

বিতর্কিত বা লোকজন সবার সামনে স্বচ্ছন্দে আলোচনা করতে চান না, এসব বিষয়ে অকপটে নিজেদের ভাবনা তুলে ধরেছেন মনীষা ও নন্দিতা। বাণিজ্যিক ছবির ‘আইটেম সং’, নারীর গায়ের রং, ওজন বা বয়স, অভিনয় জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই, ছেলেমেয়ে বড় করা—এ রকম নানা বিষয় তাঁদের আলোচনায় উঠে আসে।

অধিবেশনের শেষের দিকে দর্শকদের প্রশ্নের জবাবে ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন মনীষা কৈরালা। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে নারী হয়ে জন্মানো মানেই অলি-গলি, বাড়ি বা কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হওয়া। এসব কিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করেই এগোতে হয়। তিনি মনে করেন, যাঁরা প্রকাশ্যে অভিযোগ করছেন, তাঁদের হিম্মত আছে। অভিযোগের তদন্ত ও দোষ প্রমাণিত হলে কঠোর সাজা হওয়া উচিত নিপীড়কদের। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও বিচার হয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী তিনি নন।

এখন মেয়েরা অনেক সাহসী, তারা যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আগের মতো ‘সহনশীল’ নন বলে মনে করেন নন্দিতা দাস।

মনীষা ও নন্দিতা বলেছেন, তাঁরা দুজনই বৃত্তের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। মনীষা ভালো গল্প খুঁজেছেন, চরিত্রটা দেখেছেন, তারপর ছবি করেছেন। যে কাজে নিজে সন্তুষ্ট হবেন না, সেটা করেননি।

মনীষা বলেন, নারী সফল কি অসফল, তার বিবেচনা হচ্ছে তিনি বিয়ে করেছেন কি না। দেখা যায়, মেধার চেয়েও বয়স, ওজন, চামড়ার রং বেশি গুরুত্ব পায়। একজন ষাট বছরের নায়ক কুড়ি বছর বয়সী নায়িকার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে সিনেমা করেন। অন্যদিকে চল্লিশ হলেই মেয়েদের চলে যেতে হচ্ছে মায়ের ভূমিকায়। এটা এড়ানোর জন্য অনেক নারী একটার পর একটা অস্ত্রোপচার করিয়ে যাচ্ছেন।

নন্দিতা বলছিলেন তাঁর ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ প্রচারাভিযানের কথা। তিনি যে পরিবারে জন্মেছেন, সেখানে চামড়ার রং কী, তা নিয়ে কখনো কোনো আলোচনা হয়নি। তবে সমাজ তাঁকে বুঝিয়ে ছেড়েছে, তাঁর গায়ের রং কালো। প্রচারাভিযানে যুক্ত হওয়ার পর তিনি আরও গভীরভাবে বুঝতে পারেন, গায়ের রং কালো হওয়া নিয়ে মানুষ কতটা হীনম্মন্যতায় ভোগে। নিজের মেধা ও মননশীলতাকে শাণিত করার বদলে ত্বক ফর্সা করার জন্য নারীরা সময় ব্যয় করে। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এই ধারণা থেকে চলচ্চিত্রশিল্পও মুক্ত নয়। নন্দিতা বলছিলেন, বলিউডে কালো চামড়ার যেসব অভিনেতা এসেছিলেন, দিনে দিনে তাঁরা কেবল ফর্সাই হয়েছেন।

গতানুগতিকতার বাইরে থেকে যাঁরা অভিনয় করছেন, তাঁরা ‘আইটেম নাম্বার’কে কীভাবে দেখেন? মনীষার মতে, রুচিশীল উপস্থাপনায় ক্ষতি নেই। তবে নন্দিতা খুব স্বচ্ছন্দ নন। নারীকে মাঝখানে রেখে কিছু মানুষের অপ্রীতিকর অঙ্গভঙ্গি তাঁকে পীড়িত করে।

এই সমাজের নারীদের জন্য কী বলতে চান নন্দিতা দাস? অধিবেশনের শেষ প্রশ্নের জবাবে বলেন, একজন নারী হয়তো মহাসমুদ্রে একটা বিন্দুর মতো। তবে সেই বিন্দুকে পূর্ণ হতে হবে, স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী হতে হবে। মহাত্মা গান্ধীকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, দুনিয়াটাকে বদলাতে চাইলে নিজেকে বদলাতে হবে আগে। আর মনীষা? তিনি চান, নারী যেন হয় যোদ্ধার মতো।