নবীন দল ওপেন স্পেস থিয়েটারের দ্বিতীয় প্রযোজনা আগাথা ক্রিস্টির অ্যান্ড দ্যান দেয়ার ওয়ার নান। অনুবাদ ও নির্দেশনা এম আরিফুর রহমানের। মুখ্য সংগঠক মাহজাবিন চৌধুরী। আগাথা ক্রিস্টি বিশেষ ঘরানার জনপ্রিয় লেখক, তাঁর লেখা থেকে নাটক বলে মনের একধরনের প্রস্তুতিও থাকে।
মিলনায়তনে ঢুকে মঞ্চজোড়া বিশাল ঝলমলে মায়াবী এক প্রাসাদসম স্থাপনা-গৃহ। বড় এই স্থলে না জানি কত কী রহস্যঘন উন্মোচন ঘটবে! নতুন নিয়োগকৃত দুজন ব্যক্তিগত সহকারী আর দুই কর্মচারী প্রতীক্ষায় উদ্গ্রীব। জানা যায়, এ প্রাসাদের কর্তা মি. ওয়েনের আমন্ত্রণে সপ্তাহান্তে আতিথ্য নেবে সাত অতিথি ছোট এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে—ইংলান্ডের ডেভন উপকূলে। একে একে নানা পেশার অতিথিরা আসতে থাকে। তাদের পেশা ও বয়সানুগ চালচলন, হাবভাব, বিচিত্র পোশাক–আশাক, অভিনয়ে একেক স্বভাব প্রকাশ করতে থাকে। অভিনেতাদের চর্চা-দক্ষতা-অভিনিবেশ তাতে ধরা যায়। আমরা এক রহস্যামদির নাট্যদর্শনে তৈরি হতে থাকি। নৈশভোজ-পূর্ব পান আর তা নিয়ে মজার পশ্চিমা খুনসুটি চলছে পারস্পরিক। অথচ স্বয়ং আমন্ত্রণকর্তা কেন যে অনুপস্থিত, তা নিয়ে মিশ্র মতভেদ। অকস্মাৎ রেকর্ড বেজে ওঠে—আয়োজকের তরফ থেকে অভিযোগ: উপস্থিত সবাই একেক নির্দিষ্ট খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত। তাতেই শুরু হয় নাট্য ঘটনাঘটন। কেউ নাকি তারা চেনেই না মি. ওয়েনকে। পারস্পরিক অভিযোগ ও আত্মপক্ষ সমর্থনে জবানবন্দি চলতে থাকে। তাতে স্পষ্ট হতে থাকে বিচিত্র পেশাজীবীদের ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট কৃতকর্মাদি। সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বিচারক, চিকিৎসক, নাবিক, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী তারা—তাদের বয়ান থেকে স্পষ্ট হতে থাকে যেন আজকের বাংলাদেশেরও বাস্তব, যেখানে আত্মস্বার্থে কেউ কাউকে আর বিশ্বাস করছে না, পারস্পরিক সংশয়-সন্দেহে অভিযুক্ত করছে একে অপরকে। বাঁ পাশের বোর্ডে রহস্যঘন ছড়া সংখ্যাক্রমে সাজানো—তার নিচে দশটি পুতুল সারিবদ্ধ সাঁটা। শুরু হয় ধারাবাহিক খুন ও তা নিয়ে পারস্পরিক অভিযোগের তীব্রতা। একেকটা ছড়া পড়া হয়, দেখা যায় পুতুলের সংখ্যা কমছে ক্রমে, ছড়ার মধ্যে ইঙ্গিত মিলছে কোন পেশাজীবী খতম হয়। দেখা যায়, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যে তার এক রোগীকে খুন করেছে। স্নায়ুচাপ বাড়তে থাকে আমাদেরও। বিচারের নামে অন্যায়ভাবে আসামিকে ফাঁসি দেয় বিচারক, নাবিক জনাকয়েক আদিবাসীকে খতম করেছিল, সামরিক কর্মকর্তা তার স্ত্রীকে খুন করেছে, কর্মচারী তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে মেরেছে; কে কাকে কেন কীভাবে খুন করে বা করেছে, এর বয়ান চলতে থাকে। আমরা এক মৃত্যু উপত্যকায় নিমজ্জিত হই। এখান থেকে পালানোর উপায় নেই যেন, কোনো বোট আর পাওয়া যাবে না বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে। তাতে শ্বাসরুদ্ধকর নাট্যক্রিয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের বাস্তব বর্তমানেও সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
শিল্প বা থিয়েটারের কাছে এই তো আমরা চাই, তাতে যেন নিজেকে আর নিজেদের সমূহ দর্শন-শনাক্তকরণ ঘটে। তাই তো বলা হয়, নাটক সমাজের দর্পণ—আমরাও তা নিয়মিত আউড়ে থাকি অভ্যাসবশত। মঞ্চের বেশির ভাগ নাটক থেকে তেমন কোনো কিছু দেখতে, প্রকাশ হতে দেখি না, কেবল বিচিত্র বাহাদুরি চলতে থাকে মঞ্চে। কিছুদিন ধরে নবীন একেকটি প্রযোজনা আমাদের হকচকিয়ে দিচ্ছে। বুঝতে পারছি, মঞ্চে নবীন রক্তের ধারাপাত ঘটেছে। তাঁরা ঘনায়মান এক পর্যুদস্ত দেশ-কাল ও মানবনিয়তির বিচিত্র ভাষ্য হাজির করতে চাইছেন মঞ্চে।
এই নাটকের নির্দেশককে তারিফ করতে হয় এমন আখ্যান বেছে নেওয়ার জন্য। চরিত্রানুগ অভিনয় সচরাচর পাই না আমরা মঞ্চে, যাতে একটি চরিত্র সত্য হয়ে ওঠে। সেই দুর্বলতা ঢাকতেই বুঝি মঞ্চে চলে হরেক ক্যারিশমার কারসাজি, অকারণ কোরিওগ্রাফির সার্কাস।
নির্দেশক ঠিকই বলেন, ‘তখনই সফল, যখন নাট্য সত্য হয়ে ওঠে; দর্শক নিজেদের ভুলে যান, মনে করেন মঞ্চে যা ঘটছে তা–ই একমাত্র সত্য।’ আমাদের তেমনই অভিজ্ঞতা, বর্তমানের বাস্তবে যেমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা আতঙ্কে পর্যুদস্ত, এই নাটকও তেমন এক পারস্পরিক পাল্টা অভিযোগ ও অবিশ্বাসের মৃত্যু উপত্যকা হয়ে ওঠে মঞ্চে।
মঞ্চ ও আলোকসজ্জায় ছিলেন আশিক রহমান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার ও পারফরম্যান্স বিভাগের শিক্ষক। আলোক সঞ্চালনও কুশীলব হয়ে উঠেছে এই প্রযোজনায়। পোশাক ও সরঞ্জামে মাহজাবিন চৌধুরী, সংগীত যৌথভাবে নির্দেশক এম আরিফুর রহমান ও জোহায়ের মাহতাব খানের এবং দলের মুখ্য উপদেশক আবদুস সেলিম।
শিল্পকলা একাডেমির মূল মঞ্চ মিলনায়তন ভরে উঠেছিল প্রথম অভিনয়ে। কুশীলব হলেন জোহায়ের মাহতাব খান, মৌ সিকদার, ফাইসাল আলম, সাদিয়া জান্নাত, নাভেদ রহমান, জাকারিয়া খান, ওয়ালিদ আদনান, সৈয়দ আজাদ আহমেদ, রাফিয়া চৌধুরী, এম আরিফুর রহমান ও তাহমিদ সুপ্রভ।
আগাথা ক্রিস্টি লিমিটেডের ছাড়পত্র ও অনুমোদন নিয়ে এই নাট্যের অনুবাদ ও অভিনয়, এতেও দলের মতি ধরা পড়ে। বেশ আটঘাট বেঁধে নেমেছে নবীন এই দল—তাদের জয় হোক।
লেখক: সংস্কৃতিকর্মী