সম্প্রতি ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ভারত রত্ন অর্জন করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা। আজ এ উপলক্ষেই তাঁর জীবন ও সংগীত সফরের কিছু অজানা গল্প নিয়ে এবারের আয়োজন। লিখেছেন জাহীদ রেজা নূর
১.
ভূপেন হাজারিকা সমাজতন্ত্র প্রতি বিশ্বস্ত শিল্পী। তবে জীবনের শেষ ভাগে ডানপন্থী বিজেপির প্রতি সমর্থন দেন। ২০০৪ সালে গুয়াহাটি থেকে মনোয়ন নিয়ে নির্বাচনেও দাঁড়ান। পরে ভুলও স্বীকার করেছেন। তবে মানবতাবাদী সংগীতশিল্পী হিসেবেই তিনি সংগীতপ্রেমী মানুষের প্রিয়।
২.
ভূপেন হাজারিকার জন্ম আসামের সাদিয়াতে ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। ছোটবেলা থেকেই আসামের লোকজ গানের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। এই গানগুলো গাইতে পছন্দ করতেন। শিক্ষাজীবনের শুরু আসামের সোনারাম, তেজপুর, ধুবড়ি এবং বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
৩.
পল রোবসনের কথা শুনে, তাঁকে দেখে মোহিত হয়ে যান ভূপেন হাজারিকা। রোবসন নিগৃহীত হয়েছিলেন চারদিক থেকে। আমেরিকা থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র। হলিউড থেকে তিনি বিতাড়িত। স্টেজশো করার ক্ষেত্রেও এসেছে বাধা। রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোও তাঁর গান প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। এ সময়ই কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন পল রোবসন। শোনান ‘ওল’ ম্যান রিভার, হি ডোন্ট সে নাথিন্’ এই গানের আদলেই ভূপেন তৈরি করেছিলেন তাঁর অসাধারণ গানটি, ‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও...’। এ ছাড়াও পিট সিগারেরও অনুরক্ত ছিলেন ভূপেন।
৪.
শৈশবেই ভূপেন গীতিকার আনন্দীরাম দাস, পার্বতী প্রসাদ বড়ুয়া ও কমলানন্দ ভট্টাচার্যের মাধ্যমে স্থানীয় বরগীত, গোয়ালপাড়ার গান, চা–মজদুরের গান, বিহুগীতসহ গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন ও প্রভাবিত হন। পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতিপ্রসাদের প্রভাব পড়েছিল ভূপেনের মনে। হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের ওস্তাদ বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার হাত ধরেই সংগীতে পথচলা শুরু হয় ভূপেনের।
৫.
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দাঙ্গাবিধ্বস্ত আসামে বিপ্লবী সংস্কৃতি সংগঠক বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মধাই ওঝাদের সঙ্গে সারা আসাম ঘুরে গান করেছেন, দাঙ্গাবিরোধী গান করে দাঙ্গা থামিয়েছেন। এ ছাড়াও প্রগতিশীল সংস্কৃতিসেবী জ্যোতিপ্রসাদ আগারওয়াল, আব্বাসউদ্দিন, সলিল চৌধুরী, বলরাজ সাহানি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বড়ুয়া প্রমুখদের ছিলেন সহযাত্রী।
৬.
১৩ বছর সংসার করার পর ১৯৬৩ সালে প্রিয়ংবদা প্যাটেল ও ভূেপন আলাদা হয়ে যান। কেন তাঁরা আলাদা হয়ে গেলেন, সে কথা ভূপেনের মৃত্যুর এক বছর পর কানাডাপ্রবাসী প্রিয়ংবদা বলেন আসামের একটি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেন, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ভূপেনের প্রণয়ের কারণেই নাকি তাঁরা আর একসঙ্গে বসবাস করেননি। লতা মঙ্গেশকর কিন্তু তাতে খুব বিরক্ত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ভূপেনের ৩৯ বছরের সঙ্গিনী কল্পনা লাজমি।
৭.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর গাওয়া ‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ,/ জয় জয় মুক্তিবাহিনী/ ভারতীয় সৈন্যের সাথে রচিলে/ মৈত্রীর কাহিনি।’ গানটি সবার হৃদয় জয় করে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে ভূপেন হাজারিকা বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় দেখেছেন বঙ্গসংস্কৃতির স্ফূরণ। তিনি বাংলাদেশেই বঙ্গ সংস্কৃতির গভীরতা দেখেছেন।
৮.
পড়াশোনা শেষে ভারতে ফিরে ভূপেন হাজারিকা গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। পাশাপাশি আইপিটিএর (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) সক্রিয় কর্মী ও নেতা হিসেবে গণনাট্যের কাজ চালিয়ে যান। এ সময়ই তাঁর গাওয়া গণসংগীতগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
৯.
প্রিয়ংবদার সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু তাঁরা আর একসঙ্গে থাকেননি। ভূপেন আরেকটি বিয়ে করতে ভয় পেতেন। তবে কল্পনা লাজমির সঙ্গে তাঁর ছিল অসমবয়সী প্রেম। কল্পনার মামা গুরু দত্ত ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার। কিশোর বয়স থেকেই কল্পনা লাজমি ভক্ত ছিলেন ভূপেন হাজারিকার। ব্যক্তিজীবনে অগোছালো, বেহিসাবি ভূপেনকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন কল্পনা। তিনি তাঁর ম্যানেজারও হন। ১৯৭৬ সালের দিকে কল্পনা সরাসরি ভূপেনের ফ্ল্যাটে চলে যান এবং একত্রে বাস করতে থাকেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ভূপেন কল্পনাকে তাঁর সঙ্গী বলে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন। অনেক ছবির মধ্যে কল্পনা লাজমি রুদালি নামের ছবিটিও পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর সংগীতের দায়িত্বে ছিলেন ভূপেন।
১০.
২০১১ সালের ৫ নভেম্বর ভূপেন হাজারিকা মারা যান। এ বছর ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ পদকে সম্মানিত হয়েছেন প্রয়াত ভূপেন হাজারিকা।
ভূপেন হাজারিকার কয়েকটি গান