রাষ্ট্রীয়ভাবে চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। এ কারণে অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মুখিয়ে থাকেন এই পুরস্কারের জন্য। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণার পর আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাও হচ্ছে যথেষ্ট।
বৃহস্পতিবার বিকেলে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ২৮টি বিভাগে বিশিষ্ট শিল্পী ও কলাকুশলীকে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ প্রদানের ঘোষণা করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ চলচ্চিত্র অঙ্গনে সাড়া পড়ে। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় একজন চলচ্চিত্র সম্পাদকের পুরস্কার নিয়ে। নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ভিনদেশি নাগরিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার কথা না। এ ছাড়া ‘কৌতুক অভিনেতা’ বিভাগে মোশাররফ করিমের পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনা হচ্ছে।
পুরস্কার ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি কথা উঠেছে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ চলচ্চিত্রের জন্য ‘সেরা সম্পাদক’ হিসেবে ঘোষিত মো. কালামের পুরস্কার নিয়ে। চলচ্চিত্র পরিচালক হাসিবুর রেজা কল্লোল মন্তব্য করেন, ‘তামাশার শেষ নেই! ২০১৭ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্র সম্পাদক হয়েছেন একজন ভারতীয়! “ঢাকা অ্যাটাক” চলচ্চিত্রের জন্য ভারতীয় নাগরিক মো. কালাম পুরস্কার পাচ্ছেন বলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে আজ, তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক।’ এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ছবিটির পরিচালক প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন মো. কালাম ভারতের নাগরিক।
অথচ চলতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে পুরস্কারের জন্য চলচ্চিত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড যে বিজ্ঞপ্তি দেয়, সেখানে প্রথম শর্তেই বলা হয়েছে, ‘কেবল বাংলাদেশি নাগরিকগণ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন।’
বৃহস্পতিবার রাতে যোগাযোগ করা হলে ২০১৭ সালের পুরস্কারের জুরিবোর্ডের সদস্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, তিনি (কালাম) যে একজন বিদেশি, সেটা তাঁদের জানা ছিল না। সেখানে ফরমে উল্লেখ থাকে কে কোন দেশের। ওরা (প্রযোজক) তাহলে ভুল তথ্য দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এটা দেখার দায়িত্ব আমাদের না। আমাদের দায়িত্ব হলো ছবি দেখা। অফিশিয়ালি কাগজপত্র চেক করে মন্ত্রণালয়।’
ছবিটির প্রযোজক সানী সানোয়ার বললেন, ‘যখন নামগুলো প্রস্তাব করতে বলা হলো, প্রত্যেক সদস্যের এনআইডি ও পাসপোর্টের ফটোকপি দিতে বলা হয়। আমার যতটুকু মনে পড়ছে, আমরা তা জমা দিয়েছি। সে ক্ষেত্রে ওটা (মো. কালামের নাম) তো প্রস্তাবেই ছিল না।’
বিষয়টি নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর বিষয়টি তাঁদের নজরে পড়েছে। সোমবার অফিস খুললে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনে পুরস্কারটি অবশ্যই বাতিল করা হবে।
প্রসঙ্গত, কলকাতায় বসবাসরত মো. কালাম এর আগেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। সম্পাদনা করেছেন ‘পোড়ামন ২ ’, ‘দহন’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রে। তাঁর সম্পাদিত ‘বস’, ‘খোকা ৪২০ ’, ‘খোকাবাবু’, ‘বিন্দাস’, ‘প্যান্থার’, ‘কিডন্যাপ’ ছবিগুলো কলকাতায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এ বছর আরও দুটি পুরস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ২০১৮ সালে ‘কমলা রকেট’ ছবির জন্য মোশাররফ করিম পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতার পুরস্কার। একই ক্যাটাগরিতে ‘পবিত্র ভালোবাসা’ ছবিতে অভিনয় করে যৌথভাবে পুরস্কার পাচ্ছেন আফজাল শরীফ। এ ক্যাটাগরিতে আফজাল শরীফের বিষয়ে দ্বিমত না থাকলেও মোশাররফ করিমের ‘শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা’র পুরস্কার পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দর্শক। ২০১৮ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিবোর্ডের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া, চলচ্চিত্র অভিনেতা ইনামুল হক, সংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক হাসান মতিউর রহমান, অভিনেত্রী রওশন আরা রোজিনা, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার ও বাংলাদেশ চিত্রগ্রাহক সংস্থার যুগ্ম মহাসচিব তপন আহমেদ।
একই ঘটনা ২০১৭ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ক্ষেত্রে। ফজলুর রহমান বাবু ‘গহীন বালুচর’ ছবিতে অভিনয় করে নির্বাচিত হয়েছেন ‘শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা’। তিনি বলেন, ‘“গহীন বালুচর” ছবিতে আমার ব্যতিক্রম চরিত্র ছিল। তবে আর যা-ই হোক, সেটি কৌতুক চরিত্র না। খলচরিত্র বলা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই কৌতুক চরিত্রকে ছোট করে দেখছি না। বরং চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কৌতুক অভিনেতা গুরুত্বপূর্ণ।’ ২০১৭ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিবোর্ডের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া, সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা, চলচ্চিত্র অভিনেতা ও প্রযোজক এম এ আলমগীর, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম, চিত্রগ্রাহক পঙ্কজ পালিত ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম।
দুটি চলচ্চিত্রের বেশ কিছু পুরস্কার পাওয়া নিয়েও আলোচনা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহলে। ২০১৭ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিবোর্ডের সদস্য ছিলেন চিত্রনায়ক ও পরিচালক আলমগীর। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে জুরিবোর্ডে তিনি ছিলেন না। তবে এ বছর তিনি নিজে আজীবন সম্মাননার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ বছর তাঁর নিজের পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিটি জিতেছে পাঁচটি পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে ‘গল্প কথার ওই’ গানের জন্য শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে তাঁর স্ত্রী রুনা লায়লা এবং মেয়ে একই গানের জন্য আঁখি আলমগীরের শ্রেষ্ঠ গায়িকার পুরস্কার। এ বছর ‘পুত্র’ ছবিটি দর্শকের মাঝে মোটেও সাড়া ফেলতে পারেনি। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর প্রযোজিত ছবিটি এ বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ১১টি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
গতকাল পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন অভিনন্দন দেওয়া শুরু হয়, তেমনি কিছু কিছু পুরস্কার নিয়ে সমালোচনাও চলে জোরেশোরে। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন ফেসবুকে লিখেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কার্যত ‘তিরস্কার’ ছাড়া আর কিছু নয়; এ কেমন করে পুরস্কার হয়, তা বোঝা মুশকিল; পুরস্কারপ্রাপ্তদের কাজে কোনো রকম শ্রেষ্ঠত্ব, তো দেখতে পাই না। তবে এর জুরিরা কী দেখে এসব কাজকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ স্বীকৃতি দিচ্ছেন? পুরস্কার দেওয়ার জন্য কাজ না পেলে পুরস্কার দেবেন না, সেটাও তো ভালো একটি দৃষ্টান্ত...।
নির্মাতা হাসান রেজাউল লিখেছেন, ‘কৌতুক অভিনেতা বাছাই করাও একটা কৌতুক।’ অনেকে মোশাররফ করিম এবং ফজলুর রহমান বাবুর নাম উল্লেখ করে লিখেছেন, তাঁদের পুরস্কার গ্রহণ করা উচিত হবে না।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ও সর্বোচ্চ পুরস্কার হচ্ছে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। ১৯৭৫ সাল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। প্রথম দিকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার না থাকলেও ২০০৯ সালে প্রথম এই বিভাগটি চালু করা হয়।
জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরে দুই বছরের বিজয়ীদের হাতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।