হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে মাঝে মাঝে ঝলমল করে ওঠে আমাদের মন ও মনন। তেমনি ঝলকানি লাগা তিনটি গানের অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু করছি আমাদের এবারের আলোচনা। গত ১১ নভেম্বর রাত ১১টা ৩০ মিনিটে আলিফ চৌধুরীর উপস্থাপনায় এনটিভিতে প্রচারিত হলো লোকসংগীত নিয়ে সরাসরি গানের অনুষ্ঠান ‘মাটির গান’।
এদিন ছিল মরমিসাধক রাধারমণ দত্তের প্রয়াণ দিবস। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন রাধারমণ সংগীত গবেষক ও শিল্পী সুজিৎ রায়। কণ্ঠের বিচারে শিল্পী হিসেবে আমরা তাঁকে খুব বেশি এগিয়ে রাখতে পারব না। কিন্তু রাধারমণের মতো একজন লোকায়ত মরমিসাধককে গোটা জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য তাঁর যে নিষ্ঠা ও সাধনা, সেখানে তিনি অনন্য। অনুষ্ঠানে একটানা প্রায় দেড় ঘণ্টা তিনি রাধারমণের গান পরিবেশন করেছেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে রাধারমণের শুদ্ধ সুর ও সংগীতভাবনা বিশ্লেষণ করেছেন, যা আমাদের সংগীতজগতের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন ‘ভ্রমর কইও গিয়া’, ‘নাইয়া রে সুজন নাইয়া’ কিংবা ‘যাও রে ভ্রমর উড়িয়া’ ইত্যাদি পরিচিত ও জনপ্রিয় গানের আদি সুর বা মাটির সুরটি তিনি তুলে ধরেছেন এই অনুষ্ঠানে। পাশাপাশি ধামাইল গানের প্রবর্তক হিসেবে রাধারমণের অবদান, ধামাইল নৃত্যের প্রবর্তন, ভাটিয়ালি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও রাধারমণের যে বিশেষত্ব, তা–ও যেন আমরা নতুন করে আবিষ্কার করলাম এই অনুষ্ঠানে। এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য এবং এমন একজন সাধক ও গবেষককে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমরা এনটিভিকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।
এরপরের অনুষ্ঠানটি বাংলাভিশনে প্রচারিত হয় ১২ নভেম্বর সকাল ১০টা ১০ িমনিটে, ‘সুরের আয়না’। প্রখ্যাত শিল্পী ফাহমিদা নবীর উপস্থাপনায় এদিন উপস্থিত হয়েছিলেন সাধকশিল্পী এয়াকুব আলী খান ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র ইউসুফ আহমেদ খান । দুজনই শুদ্ধ সংগীতের ধারক ও বাহক। পাশাপাশি রয়েছে নজরুলসংগীতের প্রতি বিশেষ অনুরাগ। পিতা–পুত্রের এমন মেলবন্ধন যেন বাড়িয়ে দিয়েছিল অনুষ্ঠানের দ্যুতি। তাঁদের পরিবেশিত শুদ্ধ সংগীত, নজরুলসংগীত, রাগাশ্রয়ী আধুনিক গান দর্শকদের মুগ্ধ করেছে, অভিভূত করেছে। পিতার যোগ্য, অনুগত ও নিবেদিত উত্তরসূরি হিসেবে পুত্র ইউসুফ আহমেদ খানের পরিবেশনা যে কেবল দর্শকদের মুগ্ধ করেছে তা–ই নয়, করেছে অনুপ্রাণিত। অতএব এদিক বিবেচনা করে বলা যায়, এই অনুষ্ঠান আমাদের আবহমান মূল্যবোধকেও জাগ্রত করেছে। তবে অনুষ্ঠানটি পুনঃপ্রচারিত হয়েছে।
এবারে তৃতীয় যে সংগীতানুষ্ঠানটি আমরা আলোচনা করব, সেটিও প্রচারিত হয়েছে বাংলাভিশনেই, ১১ নভেম্বর রাত ১১টা ৩০ মিনিটে, ‘গানে গানে দেশে দেশে’। সৈয়দ আব্দুল হাদীর উপস্থাপনায় এদিন শিল্পী ছিলেন স্বরলিপি ও বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি। অনুষ্ঠানটি নানা দিক থেকে আমাদের কাছে অসম্পূর্ণ ও দায়সারা মনে হয়েছে। মাত্র আধঘণ্টার অনুষ্ঠান, সেখানে আবার দুজন শিল্পী, একেকজন তিনটি গানও পরিবেশন করতে পারেননি। মনে হয়েছে, যেন দর্শকশ্রোতা তাঁদের চেনার আগেই শেষ হয়ে গেছে অনুষ্ঠান। দুজনই নবীন শিল্পী কিন্তু পরিবেশন করেছেন প্রবীণ শিল্পীদের জনপ্রিয় গান। স্বরলিপির কণ্ঠে ‘আমার বাদল দিন’ এবং ‘কে কখন বাজায় বাঁশি’ উপভোগ্য ছিল, কিন্তু শিল্পী বিজনের কণ্ঠে ‘জীবনের এই যে মধুর নানা রঙের দিনগুলি’ যেন মানবেন্দ্রের ত্রিসীমানায়ও ঘেঁষতে পারেনি।
১১ নভেম্বর রাত ৯টা ১০ মিনিটে মাছুদ এ হাসানের প্রযোজনায় বিটিভিতে প্রচারিত হলো এ সপ্তাহের নাটক স্বর্গ-নীড়। নাটকটির রচয়িতা আকরাম হোসেন। অভিনয় করেছেন আরমান পারভেজ মুরাদ, জ্যোতিকা জ্যোতি, মুনিরা ইউসুফ মেমী প্রমুখ।
নাটকের গল্পটি সংক্ষেপে এ রকম, প্রথম দৃশ্যেই পথের মাঝে আগন্তুক মুরাদকে চড় দিয়ে বসে জ্যোতিকার বান্ধবী। বান্ধবীর এ উগ্রতায় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিন্ন করে জ্যোতিকা। বাসায় এসে কথাটি বাবাকে বললে বাবা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তাকে জানায়, ওই ছেলেটিকে খুঁজে বের করে তার কাছে মাফ চাইতে হবে জ্যোতিকাকে। তারপর শুরু হয় খোঁজার পর্ব। তার স্কুলপড়ুয়া খালাতো ভাই পড়ালেখা বাদ দিয়ে দিনের পর দিন পথে পথে খুঁজে বের করে সেই কালো চশমা ও পায়জামা পাঞ্জাবি পরা যুবককে। তাকে নিয়ে আসে বাবার কাছে। বাবার প্রথম সাক্ষাতেই যুবককে এত ভালো লাগে যে একপর্যায়ে মেয়ে জ্যোতিকার সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। এরপর যথারীতি বিয়ে হয়। শেষে বাসরঘরে ঢুকে চড় দেওয়া সেই বান্ধবী এসে মাফ চাওয়ার মধ্য দিয়ে নাটকের যবনিকাপাত হয়।
নাটকটি দেখছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম বিটিভির নাটক আটকে আছে সেই পুরোনো বৃত্তেই। প্রথমে কাহিনির কথাই বলি, মেয়েটি কেন অচেনা যুবককে পথিমধ্যে এভাবে চড় দিল, আর চড় খেয়ে ছেলেটি সুড়সুড় করে চলে গেল, কারণ দেখানো হলো না। আবার এ কথা শুনে বাবা কেন রাগান্বিত হলেন, কারণ তার মেয়ে তো নির্দোষ, আবার সে প্রতিবাদও করেছে। তারপরও ছেলেটিকে খুঁজে বের করা, তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়া। পুরো গল্পের মধ্যে বাস্তবতা, বিশ্বস্ততা, কার্যকারণ সম্পর্ক—সবই যেন অনুপস্থিত। গল্প আছে, নাটক আছে অথচ কোনো নাটকীয়তা নেই। বাবা যা চাইছে, সব ঘটে যাচ্ছে সাবলীলভাবে। আশপাশের সব চরিত্র যেন কলের পুতুল। আশপাশের চরিত্রগুলোর যেন নিজস্ব কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। সমাজ ও জীবনের বাস্তবতা কি এমন সরল হয়!
অন্যদিকে অভিনয় গ্রহণযোগ্য মেনে নিলেও ২০ বছরের নায়িকা ও সদ্য পাস করা যুবক নায়ক চরিত্রে মুরাদ ও জ্যোতিকাকে কি গ্রহণযোগ্য মনে হয়? বিটিভির এখন উচিত নতুনদের সুযোগ করে দেওয়া। নতুন নাট্যকার, নতুন শিল্পী সৃষ্টিতে তো একদা বিটিভিই ছিল নিয়ামক। তাহলে আজ তার এমন দুর্গতি হবে কেন? কারণ কি এর নীতিমালা, নাকি উদ্যোগের অভাব, নাকি দায়িত্ববোধের অভাব, আমরা জানি না। তবে কারণ যেটিই হোক, আমাদের কাছে মনে হয় বৃত্ত ভাঙাটাই এখন বিটিভি নাটকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।