করোনাকাল যত দীর্ঘ হচ্ছে, অনিশ্চয়তা তত বাড়ছে চিত্রপরিচালকদের। কয়েক বছর ধরে সিনেমার মন্দায় খুব একটা ভালো কাটেনি তাঁদের। গত চার মাস ঘরে বসে থেকে মহাসংকটে পড়েছেন তাঁরা। কাজ না থাকায় ধারদেনায় পর্যবসিত তাঁদের জীবন। কেউ খুঁজছেন বিকল্প কাজ।
এফডিসিকেন্দ্রিক ও স্বাধীন ধারার বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র পরিচালকের কাছ থেকে জানা যায়, সিনেমার বাজার মন্দা থাকায় বছরে দু-একটি কাজ করে কোনোমতে তাঁরা টিকে ছিলেন এত দিন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে গত চার মাস শুটিং বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে নতুন ছবির জন্য প্রযোজকেরাও বিনিয়োগে আগ্রহী নন। যেসব পরিচালক কেবল সিনেমার ওপরেই নির্ভরশীল, সংসার চালাতে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ কেউ সেই আর্থিক সংকটের কথা বলতেও পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিচালক বলেন, 'গত চার মাস বাসাভাড়াসহ পরিবারের খরচ মেটাতে ব্যয় হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। সঞ্চিত যা ছিল, তা দিয়ে চার মাস কোনোমতে চলেছি। আর পারছি না।' তিনি জানান, পেশাদার প্রযোজকেরা আগেই সরে গেছেন। বিচ্ছিন্নভাবে যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁরা এখন নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাইছেন না। সিনেমা ছেড়ে তাই অন্য কিছু করার কথা ভাবছেন তিনি।
কোনো কোনো পরিচালক সিনেমা ছাড়াও বিজ্ঞাপন, ওয়েব সিরিজ ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে ঝুঁকছেন। তাঁরা জানান, সেখানেও তেমন কাজ নেই। কোনো কোনো পরিচালক গ্রামে গিয়ে মাছ চাষ, গরুর খামার দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছেন। পরিচালক সাফি উদ্দিন বলেন, 'গত কয়েক বছর সিনেমা কমে যাওয়ায় পরিচালকদের হাতেও ছবি কমে গেছে। একজন পরিচালক ছবিপ্রতি পারিশ্রমিক নেন তিন থেকে ছয় লাখ টাকা। কিন্তু ঢাকা শহরে একজন পরিচালকের পরিবার নিয়ে থাকতে বছরে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ হয়। তাই বেশ কয়েক বছর ধরেই পরিচালকেরা স্বস্তিতে নেই।'
মহামারির কারণে দুটি ছবির শুটিং আটকে আছে দীপংকর দীপনের। ছবি দুটির বাকি শুটিং শুরু করা না গেলে প্রযোজকের কাছ থেকে কোনো অর্থ আসবে না। তা ছাড়া নতুন ছবির অগ্রগতিও হবে না। ফলে তাঁরও টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দীপন বলেন, 'সঞ্চিত টাকা ও প্রযোজকের সহযোগিতায় গত চার মাস টিকে থাকার চেষ্টা করেছি। শুধু সিনেমার ওপর ভরসা করে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।' এই পরিস্থিতিতে দীপন ঝুঁকছেন বিজ্ঞাপন, প্রামাণ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্যের মতো ছোট পরিসরের কাজে। তিনি জানান, ভিডিও-অডিও প্রডাকশনবিষয়ক একটি অনলাইন কোর্সে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন তিনি।
ইত্তেফাক, পরান ও স্বপ্নবাজি নামের তিনটি ছবির কাজ আটকে আছে রায়হান রাফির। সিনেমা বন্ধ বলে ওয়েব সিরিজ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য শুরু করছেন তিনি। রাফি বলেন, 'বসে না থেকে অন্য মাধ্যমে কাজ করছি। সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছি। আয়ও হচ্ছে, কাজের মধ্যেও থাকা হচ্ছে।' পরিচালক অনন্য মামুনের বন্ধন ছবিটি মুক্তির অপেক্ষায়। সাইকো ও মেকআপ ছবি দুটির বাকি অল্প কিছু শুটিং। শুরু করার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে নবাব এলএলবির শুটিং। রোজগার বন্ধ। টেকার তাগিদে একটি অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি। তাতে মোটামুটি চলে যাচ্ছে তাঁর।
সংকট প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, 'শুধু পরিচালকেরাই নন, সিনেমার সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। শুটিং নেই, ছবি নেই। কাজ না হলে আয় আসবে কোথা থেকে? বেঁচে থাকার জন্য সিনেমার বাইরে গিয়ে পরিচালকেরা একেকজন বিকল্প পথ বেছে নিচ্ছেন। এই মুহূর্তে বেঁচে থাকাটাই আসল কথা।'
এই সংকট কত দিন থাকবে, কেউ জানেন না। সংকটকালীন সময় দীর্ঘ হলে বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকবেন অনেকেই। তবে তাঁরা আশাবাদী, দ্রুত কাজে ফিরতে পারবেন।