ষাটের দশকের শেষে আমার সবে কৈশোরে পা। ওই বয়সে প্রথম টেলিভিশন দেখা। তখন শুধু ঢাকাতেই দেখা যেত। তো ঢাকা ভ্রমণ শেষে যখন ঈদের আগে দেশে ফিরে যাচ্ছি (এখনো সবাই ঈদে বাড়িতেই যাই) তখন এক নিকট আত্মীয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা ঈদে কী করো?’ আমার ফিরিস্তি শোনার পর তিনি বলেছিলেন, আমাদের ঢাকায় ঈদ মানে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখা আর ভালো ছবি এলে সিনেমা হলে গিয়ে দেখা। বোঝাই যায়, শহুরে ঈদ উদ্যাপনের বড় অনুষঙ্গ হয়ে আছে টিভি অনুষ্ঠান আর নতুন ছবি রিলিজ —অনেক আগে থেকেই।
ঈদুল ফিতরে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার বিষয়টি যে কত জনপ্রিয় ছিল, সেটা বোঝা যেত ঈদ আসার বেশ আগে থেকেই, টিভিতে বিভিন্ন টেলিভিশন সেট প্রস্তুতকারীর বিজ্ঞাপন দেখে। অর্থাৎ রোজার ঈদে যাদের বাড়িতে টিভি সেট নেই, তাদের নতুন টিভি কেনার চাহিদা অথবা পুরোনো টিভি সেট পাল্টে ফেলে নতুন টিভি সেট কেনা; যেমন ঈদুল আজহা আসার আগেই আমরা বুঝতাম ফ্রিজের বিজ্ঞাপন দেখেই। তো ঈদুল ফিতরে টেলিভিশন কেনা যে টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর জন্যই, তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই অনুষ্ঠানের ভাবনাটা তাঁরাই ভাবেন, যাঁরা টেলিভিশন চ্যানেল চালিয়েছেন। আমাদের এখানে এর শুরু বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি থেকে। যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ঈদকে কেন্দ্র করে এই বিশেষ অনুষ্ঠান নির্মাণের শুরু সেই পাকিস্তান আমল থেকে। পবিত্র রমজান মাসের শুরু থেকেই ভিন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ শুরু হতো—যত না ধর্মীয় ভাবনা থেকে, তার থেকে বেশি আমাদের সংস্কৃতি আর নিজের উৎসবের বিশালতা প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই। যেমন, সেই সময়ে ঢাকার সাহ্রি পার্টি, চকবাজারের রকমারি ইফতারি আর পুরান ঢাকার মসজিদের কারুকাজ নিয়ে অনুষ্ঠান তখন পাকিস্তান টেলিভিশনের সব স্টেশন থেকেই প্রচারিত হয়েছে। আবার নাটকসহ বিবিধ অনুষ্ঠান নির্মাণ শুরু হয়েছে ঈদকে কেন্দ্র করেই। শুনেছি সে সময়কার টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা দুই–তিন মাস আগে থেকেই শুরু করতে হতো। বিষয়বস্তু নির্ধারণ হতো খুব জোর দিয়ে। তখনো শিশুদের অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হতো ঈদের অনুষ্ঠানমালা। নাটক হতো বেশির ভাগই কমেডি ঘরানার। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসে যেন উপভোগ করা যায়, সে রকম নাটক আর অনুষ্ঠানই পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেত বিনোদন এবং রুচির সুষম মিশ্রণে।
তবে স্মৃতিতে এখনো আমাদের জ্বলজ্বলে হয়ে আছে সদ্য প্রয়াত আমজাদ হোসেনের সেমাইয়ের নাটক। মানে তাঁর নাটক শেষ হতো হয় জেলখানায় বা বাড়িতে ঈদের দিন ‘জব্বার আলী’র সেমাই খাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেই হাসির নাটক কি শুধুই হালকা বিনোদন বা হাসির নাটক ছিল? নাকি দুর্নীতিবাজ, ভেজাল দেওয়া ব্যবসায়ীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে পরিবারসহ সবার প্রতিবাদ ও জব্বার আলীর সাজার বার্তা দিত? সমসাময়িক অনেক অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যও আমাদের ভাবাত। পরবর্তী সময়ে হুমায়ূন আহমেদের নাটকও এই সামাজিক সমস্যার অনুষঙ্গগুলো ছেড়ে যায়নি, বরং মানুষকে সাহসী করেছে। খুব সূক্ষ্মভাবে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে, আধুনিক হতে শিখিয়েছে। বিটিভির ঈদের আনন্দ মেলাও তুমুলভাবে জনপ্রিয় ছিল। সেখানে পরিবেশনা ছিল নান্দনিক, ভীষণ রুচিসম্মত ও বুদ্ধিদীপ্ত। মাঝে ছোট্ট করে হলেও কোনো সামাজিক সমস্যা বা মানুষের কল্যাণের জন্য বিশেষ প্রতিবেদন থাকত, যা নিয়ে মধ্যবিত্ত মানুষ আলোচনা করত ঈদের পরের সময়টায়। ছোটদের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ঈদের বিশেষ সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠান—সবকিছুতেই একটা শিল্প, নান্দনিকতা, সুরুচি আর প্রগতিশীলতার ছাপ পরিলক্ষিত হতো বলে আমার মনে হয়। যেকোনো সৃজনশীল কাজের গ্রহণযোগ্যতার জন্য এই রুচি, নান্দনিকতা প্রগতিশীলতা আর সমাজমনস্কতা খুবই প্রয়োজন; বিশেষ করে টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমে। মানুষ তার আশা, স্বপ্ন আর প্রতিবাদের ভাষা সেখানে দেখতে চায়। তাই গণমাধ্যমের জন্য গণতন্ত্র খুবই প্রয়োজন, যে গণতন্ত্রের সঙ্গে দায়িত্বশীলতাও থাকা জরুরি।
তখন ঈদের অনুষ্ঠান এক দিনই হতো। পরের দিন সেটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ভালো লাগা–মন্দ লাগা নিয়ে কথা হতো। পত্রপত্রিকায় অনেক আলোচনা–সমালোচনা হতো। বাণিজ্যিক দিকটা বেশি প্রাধান্য পেত না। আজকের দুনিয়ার বাণিজ্যকে ভাবনায় না নিয়ে কাজ করা তো মুশকিল, বিশেষ করে প্রাইভেট চ্যানেলগুলোর। কিন্তু বাণিজ্যের কাছে আমরা যাব না, বাণিজ্য আসবে আমাদের কাছে—সেই ভাবনায় অনুষ্ঠান নির্মাণ করা জরুরি। অনুষ্ঠান এক দিনের হোক কিংবা সাত দিনের, তার থেকেও বড় কথা হলো মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়া; এটা বোঝা, তার স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার জায়গা এখন কোনটি? এখন নুসরাতকে নিয়ে যেখানে প্রতিবাদের ঝড় উঠতে পারে, তাহলে আমাদের নাড়ির স্পন্দনটা কী, তা বুঝতে তো বিশাল গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না।
ঈদে নতুন ছবি মুক্তি পাওয়াটাও আমাদের ঐতিহ্যের মতোই হয়ে গিয়েছে। কতজন মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখছে, সেই আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, সিনেমার প্রতি আমাদের আগ্রহটা কিন্তু আছে। তবে গতানুগতিক যে ধারা, তা আর আমাদের আকর্ষণ করতে পারছে না। আমার মনে হয়, সেখানে সমাজ, মানুষের বর্তমান চিন্তা–চেতনার প্রতিফলন বোধ হয় আমরা ঘটাতে পারছি না। স্বল্প পুঁজিতে ভালো সিনেমা তৈরি এখন বোধ হয় সময়ের দাবি। ভালো বলতে সেই সিনেমার কথা বলছি, যেখানে আমি আমার মানুষ, তার স্বপ্ন, আমার আকাঙ্ক্ষা আর যুক্তিবোধের সঙ্গে সামাজিক প্রতিবাদের ভাষাটা দেখতে পারবে এবং অবশ্যই তা সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে।
একটু নতুন করে ভাববার খুব প্রয়োজন আমাদের টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও সিনেমা নিয়ে। কেননা, এই মাধ্যমের প্রতি মানুষের আগ্রহ এখনো অনেক। আমি নিঃসন্দেহে এবং বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, আমাদের দেশে প্রতিভাবান মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়।
লেখক: অভিনেতা