বাঙালির জয়যাত্রায় উদ্দীপ্ত কবিতা উৎসব শুরু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের খোলা ময়দানে জাতীয় কবিতা উৎসব উদ্বোধন করেন কবি আসাদ চৌধুরী। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের খোলা ময়দানে জাতীয় কবিতা উৎসব উদ্বোধন করেন কবি আসাদ চৌধুরী। ছবি: প্রথম আলো

কবির হাতে ছিল পাঁচটি গোলাপ। আঘাতের আশঙ্কায় কাঁটাগুলোকে নখ দিয়ে তুলে ফেললেন তিনি, কবি আনিসুল হক। ফুলগুলো নিয়ে তিনি যাবেন রুবী রহমানের কাছে। মাত্র কয়েক গজ তাঁদের দূরত্ব। এর মধ‍্যে সেলফি শিকারিদের ভিড়। তাঁদের বিমুখ করেননি তিনি। ছবি তুলেছেন। তারপর রুবী রহমান ও কাজী রোজীর কাছে গিয়ে তাদের হাতে লাল গোলাপগুলো তুলে দিয়ে শুভেচ্ছা জানান তিনি। চারপাশে বসে ছিলেন আরও অনেক কবি। জাতীয় কবিতা উৎসব বলে কথা। যেদিকেই চোখ যায়, দেখা যায় কবিদের মুখ। চোখ পড়ে যায় কবির চোখে।

আজ শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের খোলা ময়দানে শুরু হয়েছে ৩৩তম জাতীয় কবিতা উৎসব। কবিতা পরিষদের আয়োজনে উৎসবের উদ্বোধন করেন কবি আসাদ চৌধুরী। সংগঠনটির সভাপতি মুহাম্মদ সামাদের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত, আহ্বায়ক রবিউল হুসাইন। উৎসবের ঘোষণাপত্র পড়েন রুবী রহমান এবং শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন আমিনুর রহমান সুলতান।

জাতীয় কবিতা উৎসব উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় র‌্যালি বের করা হয়। ছবি: প্রথম আলো

উৎসব শুরু করার আগে সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানান কবিরা। পরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর পর শুরু হয় কবিতা উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে উৎসব পতাকা উত্তোলন করেন কবিরা।

আসাদ চৌধুরী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পশ্চিমা গণতন্ত্রের আশঙ্কায় সতর্ক করে বলেছিলেন, একটা সমাজে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লোভকে যখন অপরিমিত মাত্রায় বাড়তে দেওয়া হয় এবং অন্যের দ্বারা তা প্রবুদ্ধ হয়ে থাকে, তখন পশ্চিমের দেশে যাকে গণতন্ত্র বলে তা রূপায়ণ আর সম্ভব হয় না। এ রকম পরিস্থিতিতে ব‍্যক্তিতে ব‍্যক্তিতে অবিরাম সংগ্রাম চলতে থাকে আপন আকাঙ্ক্ষা পূরণ আর স্বার্থসিদ্ধির জন‍্য তারা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দখল করতে চায়। গণতন্ত্রের তখন একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায় ধনীদের আনন্দবিহারের হস্তিবাহক হয়ে ওঠা।’

তারিক সুজাত বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্সটারনাল পাবলিসিটি উইংয়ের কার্যক্রম আরও গতিশীল করা দরকার। একজন কবি-লেখকের প্রধান দায়িত্ব তার সৃজনশীল ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব‍্যবহার নিশ্চিত করা। আর সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সেই সৃষ্টিকর্ম নিজ দেশ ও বিশ্বব‍্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের লেখকদের সেরা সাহিত‍্যকর্মগুলো নিয়ে কোনো রাইট ক‍্যাটালগ তৈরি করে আন্তর্জাতিক কোনো বইমেলায় নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাহলে মাতৃভাষার জন‍্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া জাতির সাহিত্যকর্ম বিশ্বের সংযোগ ঘটানোর দায়িত্ব কে নেবে।’

জাতীয় কবিতা উৎসবের মঞ্চে দেশি-বিদেশি অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো

সভাপতির বক্তব‍্যে মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘আগামী বছর থেকে পয়লা ফেব্রুয়ারি সরকারিভাবে জাতীয় কবিতা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এ জন‍্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এই আহ্বান পৌঁছে দেওয়া হবে।’

কবিতা উৎসবে ভারতের বিভিন্ন রাজ‍্য থেকে এসেছেন সেমন্তী ঘোষ, সুমন গুণ, দিলীপ দাস, মৃণাল দেবনাথ, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, শোভা দেববর্মণ, দীপক হালদার, বিধানান্দ পুরকায়স্থ। তুরস্ক থেকে এসেছেন তারিক গুনারসেল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্লারি বুকার, চীনের তানজিয়ান চাই, শ্রীলঙ্কার জয়শঙ্কর সুব্রামানিয়াম, ইরাকের আলী আল সালাহ, মালয়েশিয়া মালিম ঘোজালি, স্পেনের জুলিও পাভানেত্তি, উরুগুয়ের অ্যানাবেল ভিলার, কঙ্গোর কামা কামান্দা ও নেপালের পুষ্প কাহনাল।

উৎসবে স্প্যানিশ ভাষায় কবিতা পড়েন কামা কামান্দা, একই ভাষায় নারীদের উৎসর্গ করে কবিতা পড়েন নারী কবি অ্যনাবেল ভিলার। আজ দিনব‍্যাপী এ উৎসবে চলবে মুক্ত আলোচনা ও কবিতাপাঠ। আগামীকাল সকাল থেকে দিনব‍্যাপী থাকবে সেমিনার ও কবিতাপাঠের আয়োজন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ৫০ বছরে শ্রদ্ধা জানিয়ে এবারের কবিতা উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে শহীদ আসাদ, শহীদ ডা. শামসুজ্জোহা, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও শহীদ মতিউর রহমানকে।