‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল, তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। জাত–ধর্ম হৃদয়ের প্রেমধর্ম। যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সব রকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী নজরুল। তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ হিসেবে আমি এই সত্য উপলব্ধি করেছি।’
এ মন্তব্য জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জয়ন্তীতে প্রথমবারে মতো অনলাইনে ‘সাম্যবাদে নজরুল’ প্রতিপাদ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন মুক্ত আসর এ আয়োজন করে ‘আমিই নজরুল আন্তর্জাতিক নজরুল উৎসব’। এ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে বক্তব্য দেন কবির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে দুই দিনব্যাপী ‘আমিই নজরুল আন্তর্জাতিক নজরুল উৎসব’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি নজরুল গবেষক, জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য, নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী, ভারতের গবেষক ও লেখক অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী, কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল, বাংলাদেশ ইতিহাস অলিম্পিয়াড জাতীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবেদা সুলতানা, পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ, উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ফারুক আহমেদ।
জাতীয় অধ্যাপক, নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২২-২৩ বছরের একজন যুবক একটি কবিতা লিখেছেন “বিদ্রোহী” নামে। সেই কবিতা বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং অদ্যাবধি তা বিদ্যমান। সে কবিতা কেবল নজরুলের নয়, আমি বলব, বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বলশেভিক বিপ্লবের পর টি এস ইলিয়ট “The Wasteland” কবিতা লিখেছিলেন, যেটি ইংরেজি কবিতার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তেমনি নজরুলের “বিদ্রোহী” এই কবিতার আগে রচিত। কবিতাটিও বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারাকে বদলে দিয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতার আবহের বাইরে অনেকেই বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু সফলকাম হননি, নজরুল তা হয়েছিলেন।’
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাঙালির চিত্ত জাগরণকারী এক আশ্চর্য মানুষ নজরুল। “গাহি সাম্যের গান” কথাটি বিচ্ছুরিত হচ্ছে নানাভাবে। বারবার নজরুল পড়ছি মানে নজরুলকে পুনঃপাঠ, আগের চেয়ে আরও বেশি করে জানা। নজরুলকে তো আর টুকরো করে আনা যায় না। আমরা কী নজরুলকে পূর্ণরূপে বুঝতে পেরেছি, নাকি অন্ধের মতো আমিও একজন। তাই তাঁর পূর্ণরূপ বুঝতে নজরুল রচনাবলিসহ সবকিছু সঠিকভাবে পাঠ করা।’
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের মানবিকতাকে, চেতনাবোধকে জাগ্রত করেছেন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। গণমানুষের কাছে পৌঁছেন। মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদাকে দেখেছেন, ধর্মের দিককে আগে তুলে ধরেননি। বাঁচার অধিকারের দিকটিকে ধর্মের সুন্দর জায়গার দিক থেকে দেখেছেন। এভাবে নজরুল আমাদের সামনে সাম্যবাদের চেতনা নিয়ে এসেছেন।’
কবির নাতনি খিলখিল কাজী বলেন, ‘এখন সারা বিশ্বের বেদনায় হাহাকার। কাজী নজরুলকে এখন ভীষণ প্রয়োজন। কাজী নজরুল জীবনে কত সংগ্রাম করেছেন। জেলে গেছেন। মানবতার কথা তিনি বলেছেন। সাম্যের কথা তাঁর মতো কেউ এমন করে বলেননি।’
গবেষক ও লেখক অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী বলেন, নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক মনন৷ তাঁর বিদ্রোহী কবিতার লক্ষ্যবস্তু দুটি—এক, অত্যাচারের খড়গকৃপাণ; দুই, উৎপীড়িতের ক্রন্দন–রোল। এই হচ্ছে সাম্যবাদের মূলকথা। তিনি যখন কামাল পাশা, আমানুল্লাহ, জগলুল পাশা—এঁদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তখন তিনি বিশ্বের স্বাধীনতাসংগ্রামী। বিশ্বমানবতার স্বাধীনতার অনির্বাণ আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর মধ্যে। ধর্মগ্রন্থ পাঠের জগতেও নজরুল ছিলেন আন্তর্জাতিক মনন।
পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ হাসান বলেন, ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশকে যে আপনারা তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন। তিনি শেষজীবনে বাংলাদেশে যান, বাংলাদেশ তাঁকে যথাযথ সম্মান জানিয়েছে৷ এই কথাটা আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী কখনো ভুলব না।’
উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ফারুক আহমেদ বলেন, ধূমকেতু পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম পূর্ণাঙ্গ সরাজের কথা বলেছেন। সেই নজরুল ইসলাম আমাদের অবিভক্ত ভারতের সব মানুষের কাছে পূর্ণ সরাজের স্বপ্ন বপন করেছিলেন। তিনি এমনই একজন কবি, যার জন্য তৎকালীন ভারতের সব মানুষ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মুক্তির সংগ্রামের সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন। তিনি এভাবেই সাম্যবাদের গান গেয়েছেন।
মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ বলেন, ‘“আমিই নজরুল” উৎসবের প্রতিপাদ্য “সাম্যবাদী নজরুল”। নজরুলের যে সাম্যবাদ চিন্তা, তা বর্তমানে সারা বিশ্বের জন্যই জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, এই চেতনা তরুণদের মধ্যে লালন করা এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া।’
অনলাইনে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নজরুল উৎসবে প্রথম দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় প্রথম অধিবেশনে শত বছরে বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন ভারতের লেখক ও নজরুল গবেষক মীরাতুন নাহার ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মো. রিজাউল ইসলাম। সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন সাদিয়া রশ্নি সূচনা।
দ্বিতীয় অধিবেশন রাত নয়টায় নজরুলের গান ও কবিতা পরিবেশন করেন শিল্পী গুলজার হোসেন উজ্জ্বল, নজরুলসংগীতশিল্পী মিত্রা ঘোষ (ভারত), আবৃত্তিশিল্পী লায়লা আফরোজ ও পিনাকী চট্টোপাধ্যায় (ভারত)। সঞ্চালনা করেন শায়লা রহমান। ২৫ মে দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় অধিবেশন সকাল ১০টায় নজরুলের সাহিত্যকর্ম ও অনুবাদ নিয়ে আলোচনা করেন ভারতের নজরুল গবেষক ও অনুবাদক শেখ মকবুল ইসলাম , পর্তুগাল থেকে সংগীতশিল্পী ও বিজ্ঞানী মোস্তফা আনোয়ার স্বপন ও নজরুল গবেষক পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য। সঞ্চালনা করেন আবু সাঈদ। চতুর্থ অধিবেশন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নজরুলের সাম্যবাদ ও মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেন যুক্তরাজ্য থেকে অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান, ভারতের নজরুল গবেষক মবিনুল হক, মোহাম্মদ সামসুল আলম। সঞ্চালনা করেন মুক্ত আসরের যোগাযোগবিষয়ক সম্পাদক আয়শা জাহান নূপুর।
রাত নয়টায় অনুষ্ঠিত হয় সমাপনী অনুষ্ঠান। সমাপনী অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ নাতনি অনিন্দিতা কাজী বলেন, ‘মুক্ত আসর এমন একটি আয়োজন করায় প্রশংসার যোগ্য। নতুন প্রজন্ম নজরুল অনুরাগীকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করবে। ১২২তম জন্মজয়ন্তীতে যেভাবে দাদুকে স্মরণ করা হচ্ছে, এতে প্রমাণিত হয় নজরুল কতটা প্রাসঙ্গিক। তাঁর চিন্তাচেতনা, সাম্যবাদের যে চিন্তা তিনি করেছেন, তা নতুনভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাক।’
সমাপনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন যুক্তরাজ্য থেকে কবি ও লেখক শামীম আজাদ, বাংলাদেশ ইতিহাস অলিম্পিয়াড জাতীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ কে এম শাহনাওয়াজ, এমরান জাহান, আবেদা সুলতানা, নুরুন আখতার, আহমেদ হেলাল, উদার আকাশের প্রকাশক ও সম্পাদক ফারুক আহমেদ, মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক মনিরা পারভীন, ডায়ালগ ইনের পরিচালক পিনাকী গাঙ্গুলী, ছায়ানট ( কলকাতা) সভাপতি সোমঋতা মল্লিক প্রমুখ।
দুই দিনের এ আয়োজনে ৫টি দেশে থেকে ৩২ জন নজরুল গবেষক, শিক্ষাবিদ ও শিল্পীরা অংশ নিয়েছেন।