ব্যবসাসফল হয়েছিল যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত সিনেমা শিকারী। তারপর দর্শকপ্রিয় হয়েছিল যৌথ প্রযোজনার বেশ কিছু ছবি। সেসব ছবিতে ভারতীয় অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি কাজ করেছিলেন ভারতের চিত্রগ্রাহক, সহযোগী পরিচালকেরা। এখন বাংলাদেশের একক ছবিতেও তাঁদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। বিপুলসংখ্যক ছবিতে কাজ করছেন ভারতের কলাকুশলীরা।
মুক্তির অপেক্ষায় ও কাজ চলছে মিশন এক্সট্রিম, অপারেশন সুন্দরবন, ইত্তেফাক, বিক্ষোভ ছবিগুলোর। এসব ছাড়াও ঢালিউডের বেশ কিছু ছবিতে কাজ করছেন কলকাতার চিত্রগ্রাহকেরা। দু–একটি ছবিতে সহযোগী পরিচালকের কাজও করছেন। এমনকি কালার গ্রেডিং, সংগীত ও সম্পাদনার কাজ করতেও বিদেশমুখী হচ্ছেন বেশির ভাগ পরিচালক ও প্রযোজকেরা।
ভারত ও অন্য দেশের চিত্রগ্রাহকদের নিয়ে কাজ করছেন, এমন বেশ কয়েকজন পরিচালক জানিয়েছেন বিদেশি চিত্রগ্রাহকেরা অনেক কাজ করেন, অভিজ্ঞতাও বেশি। তাঁরা পরীক্ষিত। ফলে ভালো মানের কাজের জন্য তাঁদের দেশে আনা হচ্ছে। আবার কেউ বলেছেন, এখনকার প্রতিষ্ঠিত চিত্রগ্রাহকেরা অতিরিক্ত সম্মানী দাবি করেন, নতুনদের অভিজ্ঞতা এখনো কম। এসব কারণেই বিদেশের চিত্রগ্রাহকের দিকে ঝুঁকছেন নির্মাতারা।
মিশন এক্সট্রিম ছবির অন্যতম পরিচালক ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের চিত্রগ্রাহকেরাও ভালো কাজ করেন, তবে বড় বাজেটের এসব ছবির মানকে আরেকটু এগিয়ে নিতেই বাইরের কুশলীদের নিয়ে কাজ করা। আমাদের এখানে সিনেমার কাজ বাড়লেই এসব সমস্যা কেটে যাবে।’
ঢাকা অ্যাটাক ছবিতে কলকাতার চিত্রগ্রাহক ও সহযোগী পরিচালক নিয়ে কাজ করেছিলেন পরিচালক দীপংকর দীপন। তিনি অপারেশন সুন্দরবন ছবিতেও কলকাতার চিত্রগ্রাহক ও সহযোগী পরিচালক নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে নিয়মিত বড় বড় কাজ হলে ভালো চিত্রগ্রাহক পেতাম। তা ছাড়া ভালো যে কজন চিত্রগ্রাহক আছেন, তাঁরা বিজ্ঞাপনে বেশি পারিশ্রমিক পান। সিনেমাতেও একই পারিশ্রমিক চান তাঁরা। সেই দিক থেকে কলকাতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিত্রগ্রাহকদের বাজেটের আওতায় পাওয়া যায়।’
ইত্তেফাক ছবির পরিচালক রায়হান রাফি মনে করেন, বাংলাদেশে ভালো ভালো চিত্রগ্রাহক আছেন। তাঁদের কাজও ভালো। তিনি বলেন, ‘আমি ইত্তেফাক ছবিটি নতুন প্রজন্মের সিনেমাটোগ্রাফার রাজু রাজকে নিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর শিডিউল পাইনি। কাজটি দ্রুত শুরু করার তাগিদ ছিল। এ কারণে কলকাতা থেকে সিনেমাটোগ্রাফার আনতে হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাইফুল শাহিন, সুমন সরকার, নিখিল সাহা, খসরু ভাইয়েরা দারুণ কাজ করেন। বলতে পারি না যে ভালো চিত্রগ্রাহকের দিক থেকে পিছিয়ে আছি। বলতে পারেন, কোরিওগ্রাফি, ফাইট ডিরেকশনে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি।’
যদিও এই পরিচালকদের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন চিত্রগ্রাহক সমিতির সভাপতি আবদুল লতিফ। দেশের বাইরে থেকে চিত্রগ্রাহক আনিয়ে কাজ করার ব্যাপারে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘একজন চিত্রগ্রাহক পাঁচটি কাজের অভিজ্ঞতা নিয়েও ভালো কাজ উপহার দিতে পারেন। আবার কারও যদি পঞ্চাশটি কাজের অভিজ্ঞতা থাকে, তাঁর কাছ থেকেও অনেক সময় ভালো কাজ আসে না। যাঁরা বেশি বেশি কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলে দেশের বাইরে থেকে চিত্রগ্রাহক আনিয়ে কাজ করাচ্ছেন, এটি তাঁদের বিলাসিতা। আমার মনে হয়, সস্তায় নিজের নাম তৈরির কৌশল এটি।’
চিত্রগ্রহণে আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার সুযোগ সেই অর্থে নেই বললেই চলে। সেদিক থেকে এগিয়ে আছেন কলকাতার কুশলীরা। কলকাতার চিত্রগ্রাহকদের প্রায় ৭০ শতাংশই সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পড়ালেখা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে আবদুল লতিফ বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল্য আছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই সব নয়। ভালো চিত্রগ্রাহকের সঙ্গে বছরের পর বছর কাজ করাটা শিক্ষা থেকে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়ানো হয়। তবে চিত্রগ্রহণের ওপর আলাদা কোনো কোর্স নেই। এ নিয়ে গ্রিন ইউনিভার্সিটির মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের স্বল্পমেয়াদি কোর্সের শিক্ষক নির্মাতা জাকির হোসেন বলেন, নিমকোতে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন অব ম্যাস কমিউনিকেশন) এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি কোর্স আছে। এর বাইরে কোনো জায়গায় এসবের ওপর আলাদা কোনো কোর্স নেই। সিনেমার ক্ষেত্রে চিত্রগ্রহণ খুবই জরুরি বিষয়। এর ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটাও জরুরি। বাইরের চিত্রগ্রাহকদের নিয়ে কাজের ব্যাপারে মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিদেশি জিনিস মানেই ভালো, আমরা এখনো এ ধারণা নিয়ে আছি। আমাদের দেশের অনেকেই দেশের বাইরে থেকে চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, আলোক ব্যবস্থাপনার ওপর কোর্স করে এসেছেন। আমরা তাঁদের কজনকে কাজে লাগিয়েছি?’