মালা আর কামালের কথা কি মনে পড়ে! তাঁরা একসময়ের সেরা রোমান্টিক চরিত্র, যা মানুষের মুখে মুখে ছিল। ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে ‘মালা’ চরিত্রে শবনম আর ‘কামাল’ চরিত্রে রহমান। তাঁরা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম ও বেশি সময়ের শ্রেষ্ঠ জুটি। শুধু কি তাই, পাকিস্তানের দুই অংশে দাপটের সঙ্গে তাঁরা অভিনয় করেছেন। জনপ্রিয়তায়ও ছিলেন শীর্ষে—বাংলা কিংবা উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে।
সাদা-কালো চলচ্চিত্রের বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা রহমানের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১৮ জুলাই। তাঁর পুরো নাম আবদুর রহমান। তিনি ১৯৩৭ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রসেয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ সেই সময়ে চলচ্চিত্র অভিনয় করবে—এমন ভাবনা ছিল অবান্তর। তাও আবার অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে। একদিন বাবাকে না বলে বাড়ি থেকে লুকিয়ে পাড়ি দেন ঢাকায়। সময়টা ১৯৫৭ সাল। ২১ বছরের টগবগে তরুণ। অভিনয়ের নেশায় ঢাকায় খুঁজে পেয়ে যান আরেক কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্যাপ্টেন এহতেশামকে (আবু নুর মোহাম্মাদ এহতেশামুল হক)। তাঁর পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে তাঁর। ছবিটি ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। তারপর আর তাঁকে থেমে থাকতে হয়নি। একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে গেছেন।
খল চরিত্র দিয়ে অভিনয় শুরু হয় রহমানের। এরপর থেকে তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন ‘উত্তরণ’, ‘তালাশ’, ‘চান্দা’, ‘জোয়ার ভাটা’ ও ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে। তাঁর বিপরীতে অভিনেত্রী শবনম। এই জুটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রথম জনপ্রিয় ও সার্থক জুটি।
১৯৬৫ সালের ১৬ এপ্রিল মুক্তি পায় ‘বাহানা’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জহির রায়হান ছবিটি নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্র ব্যাপক জয়প্রিয়তা এনে দেয় নায়ক রহমানকে। তাঁর আগের চলচ্চিত্র ‘মিলন’ ব্যাপক জয়প্রিয় ছিল তৎকালীন দুই পাকিস্তানে। আরও একটি চলচ্চিত্রের কথা বলতে হয়—রহমান ও শবনম অভিনীত সর্বাধিক জনপ্রিয় ছবি ‘তালাশ’। এটি প্রায় সবক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যায়। এতে সুরকার ছিলেন শবনমের স্বামী রবিন ঘোষ। মেহেদি হাসানের একটি হৃদয়গ্রাহী গান ছাড়াও ঢাকার একটি খুব জনপ্রিয় বাংলা গানের উর্দু রূপান্তর করা হয় এখানে।
অভিনয়ের পাশাপাশি রহমান বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক, যিনি ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানোর সাহস দেখান। ১৯৬৭ সালে ‘দরশন’ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালনায় আসেন তিনি। তাঁর পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র হলো ‘দর্শন’, ‘কঙ্গন’, ‘যাহা বাজে সেহনাই’ ইত্যাদি। আর বাংলা চলচ্চিত্র ‘নিকাহ’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পাকিস্তানে উর্দু চলচ্চিত্র ‘চাহাত’, ‘দোরাহা’ ও ‘লগান’-এ অভিনয় করেন। পরে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। সেখানে নায়ক রহমান চুনি লালের চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৮১ সালে দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘অংশীদার’ চলচ্চিত্রেও তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেন। রহমান অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ছিল অশোক ঘোষ পরিচালিত ‘আমার সংসার’।
মাসুদ চৌধুরীর পরিচালিত ‘প্রীত না জানে রীত’ চলচ্চিত্রের শুটিং চলছিল সিলেটে। শুটিং চলাকালে গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি একটি পা হারান। এই দুর্ঘটনার পর পরিচালক নায়ক হিসেবে নিয়ে আসেন প্রখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা খলিলকে (খলিল উল্লাহ খান)। তিনি তখনো জয়প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। দুর্ঘটনায় পা হারানোর পর রহমানের ক্যারিয়ার বড় ধাক্কা খায়।
বাংলা, উর্দু ও পশতু ভাষার চলচ্চিত্রে সমানভাবে জনপ্রিয় অভিনেতা রহমান অভিনীত উল্লেখ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো উর্দুতে ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘মিলন’, ‘বাহানা’, ‘ইন্ধন’, ‘দর্শন’, ‘জাহাঁ বাজে সেহনাই’, ‘গোরি’, ‘প্যায়াসা’, ‘কঙ্গন, ‘দোস্তি’, ‘নাদান’; বাংলায় ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘এই তো জীবন’, ‘হারানো দিন’, ‘যে নদী মরু পথে’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘দেবদাস’।
বাংলাদেশের জাতীয়, বাচসাসসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন রহমান। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই ঢাকায় এই কিংবদন্তি অভিনেতার জীবনাবসান ঘটে। তাঁর অভিনীত ও পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো মানুষের মনে চিরকাল গেঁথে থাকবে।