>ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ও কোরিওগ্রাফার শর্মিলা বিশ্বাস। দুই দশক ধরে ওডিশি নৃত্যের শিক্ষা ও এর প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ওডিশি ভিশন অ্যান্ড মুভমেন্ট সেন্টারের সঙ্গে যৌথভাবে নৃত্যশিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশের নাচের স্কুল কল্পতরু। এ কাজে বাংলাদেশে এসে শর্মিলা কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাসেল মাহ্মুদ।
সম্ভবত অনেক দিন পর বাংলাদেশে এলেন?
শর্মিলা : হ্যাঁ, প্রায় ১০ বছর পর। সেটাও খুব অল্প সময়ের জন্য। তবে বড় একটা কাজ শুরু করতে যাচ্ছি।
শুনেছি একটা কর্মশালা করাচ্ছেন। এখানকার নাচের শিক্ষার্থীরা কেমন?
শর্মিলা: অবিভক্ত বাংলা বা ওডিশার মানুষদের সংস্কৃতির সঙ্গে এখানকার কিছুটা মিল আছে। তারা স্বভাবে খুব নম্র, খুব শিল্পিত। বাংলাদেশের লোকদের সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার লোকরাও সেটা বলেন। শিক্ষার্থীরা খুব ভালো। তবে একটা ব্যাপার দেখেছি, ভারত বা বাংলাদেশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি মেধাবী, চঞ্চল আর চটপটে। বন-জঙ্গল, পাহাড় পেরিয়ে, পুকুরে ঝাঁপিয়ে বড় হয় তারা। শহরের বাচ্চারা নড়তে-চড়তে শেখেনি। সোফা থেকে নেমে গাড়িতে ওঠে, এরপর গিয়ে চেয়ারে বসে। এসব কারণে শারীরিকভাবে তাদের একটা জড়তা আছে।
ওডিশি কেন শিখতে আর শেখাতে চেয়েছিলেন?
শর্মিলা: শিশুদের সব ধরনের শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা দরকার। সেটা আঁকা হোক, স্কেটিং হোক, যাত্রা, থিয়েটার বা নাচ। ১২–১৪ বছর বয়সে তারা নিজেরাই বুঝতে পারে যে কোনটায় যেতে চায়। আমার ভালো লেগে যায় ওডিশি। বাঙালি হিসেবে আমি ওডিশির সঙ্গে নিজেকে বেশি যুক্ত করতে পারতাম। আসলে বর্ডারগুলো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নয়। সাংস্কৃতিকভাবে আমরা এক। যদিও ওডিশি নাচ এখনো বাংলাদেশে সেভাবে জনপ্রিয় নয়। তবে সাংস্কৃতিকভাবে এক হওয়ার কারণে আশা করছি শিক্ষার্থীদের ভালো লাগবে।
নিজের সেরা পরিবেশনার কথা মনে পড়ে?
শর্মিলা: একবার একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি হয়েছিল। ছোট পরিসরের একটি অনুষ্ঠানে ১০ জন জাপানি এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁদের জন্য ঘরোয়া একটা নাচের আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁরা শিল্পী নন, আমাদের সংস্কৃতিও বোঝেন না। এমনকি ইংরেজিও খুব ভালো বোঝেন না। যেহেতু তাঁরা মাটিতে বসেন, আমিও বসলাম। মাঝখানে একটা জায়গায় রাখলাম অনেক সুগন্ধি ফুল। তাঁদের সঙ্গে নাচের কথা বলতে শুরু করলাম, আর একটু একটু করে নাচ দেখালাম। তখন যে আদান-প্রদানটা হয়েছিল, সেটা আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি, তাঁরা বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। তাঁরাও কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছিলেন, আমি সেটা বুঝছিলাম। একটা গল্পের মতো সন্ধ্যা ছিল। শিল্প যে যোগাযোগের একটা মাধ্যম, সেটা উপলব্ধি করা গেছে সেই সন্ধ্যায়।
ওডিশি নাচ আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্রে টুকটাক দেখতে পাই। এ ঘরানাকে আমাদের সিনেমায় ব্যবহার করা যাবে?
শর্মিলা: খুব যাবে। ওডিশি নাচের মধ্যে অনেক উপাদান আছে, যেগুলো দেখতে খুব আকর্ষণীয়। বিশেষ করে অভিনয়ের অংশটুকু। খুব প্রাকৃতিক, খুব চটুল। কৃত্রিমতা কম, যেটা চলচ্চিত্রের জন্য উপযুক্ত। ফোক ও মার্শাল আর্টের মুভমেন্টও আছে। অন্য ঘরানার তুলনায় এটা ভীষণ লোভনীয়।
চলচ্চিত্রের নৃত্যে কার অবদান বেশি থাকে—পরিচালকের নাকি নৃত্য পরিচালকের? ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রাঙ্গদা ছবির নৃত্য পরিচালনা করার সময় তিনি কি আপনার সব ভাবনা মেনে নিতেন?
শর্মিলা: নৃত্য পরিচালককে পরিচালনা বা নৃত্যশিল্পীদের নাচানো তাঁর কাজ ছিল না। ঋতুপর্ণের ভূমিকা ছিল কোরিওগ্রাফারের মতো। আমি সবকিছু গাইড করছিলাম, তিনি সেগুলো খুব সিরিয়াসলি নিচ্ছিলেন। তাতে মনে হচ্ছিল, নাচটা আলাদা কিছু না। আমরা কেউ কাউকে মানিনি। আলোচনা করে একটা জায়গায় পৌঁছাতাম। নৃত্য পরিচালকের সঙ্গে চিত্র পরিচালকের বেশি করে যোগাযোগ হওয়া দরকার। নাচটাকে পর্দায় ধারণ করতেও একটি বিশেষ কারিগরি লাগে।
ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
শর্মিলা: কিছু মানুষের সব ক্ষেত্রে খুব ভালো বিচরণ থাকে। নিজে নাচতে না পারলেও কোন নাচটা ভালো, সেই ধারণা ঋতুপর্ণ ঘোষের ছিল। গান করতে পারতেন না, কিন্তু আবহ সংগীতটা কেউ এসে করে দিয়ে চলে গেলেন, সে রকম সুযোগ তাঁর ছবির ক্ষেত্রে ছিল না। তিনি নিজে ভীষণভাবে যুক্ত থাকতেন।
ওডিশি ভিশন অ্যান্ড মুভমেন্ট সেন্টার ও কল্পতরু কী করছে?
শর্মিলা: নাচ নিয়ে একটি বড় পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এখানকার বাচ্চারা যাতে হেসেখেলে মজা করে নাচটা শিখতে পারে, সে রকম একটা কারিকুলাম বানাচ্ছি। সেটারই একটু ঝলক দেখাব।