কাকরাইলের চলচ্চিত্রপাড়া

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান

এফডিসি
এফডিসি

চলচ্চিত্রপাড়াখ্যাত রাজধানীর কাকরাইল থেকে আস্তে আস্তে সিনেমার আলো নিভে যেতে বসেছে। প্রায় চার যুগ আগে থেকে এই পাড়ায় গড়ে ওঠা শত শত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান একের পর এক বন্ধ হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এই এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা ছোট–বড় তিন শতাধিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই ছবি নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অফিসও।

ষাটের দশকে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণকেন্দ্র ছিল সদরঘাট, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নবাবপুর ও গুলিস্তানকেন্দ্রিক। আশির দশকের শুরু থেকে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ঘাঁটি গাড়তে থাকে কাকরাইলপাড়ায়। ওই সময় সিনেমা ব্যবসা রমরমা হওয়াতে পর্যায়ক্রমে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কাকরাইলের রাজমণি ফিল্ম সেন্টার, ফরিদপুর ম্যানশন, যমুনা বিল্ডিং, ভুঁইয়া ম্যানশন, ইস্টার্ন কমার্শিয়াল বিল্ডিংসহ কাকরাইলের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে উল্লেখ করা যায় রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন, খান আতা প্রাইভেট লিমিটেড, যমুনা ফিল্ম করপোরেশন, উজ্জ্বল ফিল্মস, আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড, সুচন্দা ফিল্মস, ববিতা ফিল্মস, জয় ফিল্মস, ডি-রাশ ফিল্মস, সনি পিকচার্স, এসডি প্রোডাকশন, নান্টু প্রোডাকশন, স্বরলিপি বাণীচিত্র, আলমগীর পিকচার্স, লায়ন মুভিজ, ভাই ভাই ফিল্মস, দেশচিত্র, আশা ফিল্মস, পারভেজ ফিল্মস, হাসনাবাদ কথাচিত্র, অমি বনি কথাচিত্র, পর্বত পিকচার্স, বাউল চলচ্চিত্র, আলিম ফিল্মস, কিবরিয়া ফিল্মস ইত্যাদির নাম। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক জনপ্রিয় গল্পের ছবি, গানের ছবি মুক্তি পায়।

গত দেড় দশকে কাকরাইলের এই সব নামী বেশির ভাগ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানই তাদের অফিস গুটিয়ে নিয়েছে। তবে ভুঁইয়া ম্যানশন ও ইস্টার্ন কমার্শিয়াল বিল্ডিংয়ে ছোট–বড় ২০ থেকে ২৫টি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অফিস কোনোরকমে টিকে আছে। নিয়মিত কোনো সিনেমা না থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কিবরিয়া ফিল্মস, আশীর্বাদ চলচ্চিত্র, জননী কথাচিত্র, হার্টবিট প্রোডাকশন, টিওটি, গীতিচিত্র কথাসহ পাঁচ–ছয়টি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অফিস খোলা হয়। তবে বন্ধ থাকা বাকি কোনো কোনো অফিস গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও চলছে।

ভুঁইয়া ম্যানশনের চারতলায় অবস্থিত মীনা ফিল্মস সবশেষ তিন বছর আগে গুণ্ডামি নামে ছবি তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রযোজক হিমেল খান জানালেন, নব্বই দশকে নেওয়া অফিসটি আগামী মাস থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সিনেমার ব্যবসা নাই, হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু শুধু অফিসভাড়া গুনতে হচ্ছে।

একটা সময় সারা বছরই কাকরাইলপাড়ায় যেন ঈদের আমেজ লেগে থাকত। নতুন ছবি মুক্তির আগে আগে সারা দেশ থেকে হলমালিক বা হলের কর্মকর্তা, বুকিং এজেন্টরা কাকরাইলপাড়ায় এসে ভিড় জমাত। সিনেমার রিল, পোস্টার, ব্যানার কাকরাইলপাড়া থেকে সারা দেশে সরবরাহ হতো। সেসব এখন শুধুই অতীত।

সেই সময় থেকে চলচ্চিত্রের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এখনো ঢিমেতালে চালিয়ে যাচ্ছেন, এমন কোনো কোনো প্রযোজক বলছেন, আশির দশক থেকে শুরু করে নব্বই দশকের শেষের দিক পর্যন্ত কাকরাইলে প্রতিদিনই যেন সিনেমার বাজার বসত। প্রযোজক, হলমালিক, হল কর্মকর্তা, বুকিং এজেন্ট, শিল্পীদের বসত মিলনমেলা। ২০০০ সালেও সেই ঢেউ ছিল। যদিও ১৯৯৫–৯৬ সালে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা প্রবেশ করায় নামী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হতে থাকে। অপেশাদার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অশ্লীল ছবির বিপরীতে টিকতে না পেরে এসব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো ছবি নির্মাণে পিছিয়ে পড়ে।

আশির দশকের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কিবরিয়া ফিল্মস স্নেহের প্রতিদান, অগ্নি তুফান, এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়েসহ বহু জনপ্রিয় ছবি নির্মাণ করে। সবশেষ বছর তিনেক আগে যৌথ প্রযোজনার ছবি ব্ল্যাক নির্মাণ করে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার কামাল মোহাম্মদ কিববিয়া বলেন, অশ্লীলতার যুগ থেকেই মূলত ভালো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো ছবি নির্মাণ বন্ধ করা শুরু করেছে। এরপর বিভিন্ন কারণে ধারাবাহিকভাবে এই সব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। এখন সিনেমা থেকে পুঁজিই ফিরছে না। সত্যি কথা কী, সিনেমার হাট ভেঙে গেছে।

আলমগীর পিকচার্স থেকে তৈরি হয়েছিল সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, শুভদা, নয়নমণিসহ অসংখ্য জনপ্রিয় সিনেমা। সবশেষ ১৯৯৮ সালে রঙিন নয়নমণি প্রযোজনা করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার এ কে এম জাহাঙ্গীর খান বলেন, অনেক আগেই সিনেমায় ভেজাল ঢুকে গেছে। সিনেমার ভালো গল্প নেই, গান নেই, হল কমে যাচ্ছে। তাই বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে।

তবে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বন্ধের এই মিছিলের মধ্যেও কাকরাইল বা কাকরাইলের বাইরে বেশ কয়েকজন একক প্রযোজক ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। জাজ মাল্টিমিডিয়া, শাপলা মিডিয়া, শাকিব খান ফিল্মসসহ কয়েকটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বছরে দুই–তিনটি করে ছবি নির্মাণ করে যাচ্ছে।