এক দশকে বদলে গেছে বিশ্ব। অন্য সবকিছুর সঙ্গে অবধারিতভাবে পরিবর্তন এসেছে বিনোদনমাধ্যমে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিনোদনমাধ্যমে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গেছে বিনোদন গ্রহণের ক্ষেত্রে। সিনেমা হল, টিভি, ডিভিডি ছাড়িয়ে বিনোদন স্থান করে নিয়েছে ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে। একটা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট–সংযোগ থাকলেই যে কেউ জামার পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারে বিশ্বের বিনোদনের জগৎ।
১৯৬৪ সালে মার্শাল ম্যাকলুহান বলেছিলেন, ‘মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ’। বাহনই বার্তা। মাত্র চার শব্দের এই বাক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সহস্র শব্দের মর্মার্থ। আর ৫৫ বছর আগে বলা সেই কথা সময়ের সঙ্গে যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের যুগে এই চার শব্দের একটা বাক্য ডালপালা মেলে আরও বেশি সত্য আর মূর্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে।
এখন আর বিনোদনকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা যাবে না। ডিজিটাল কনটেন্টগুলো তাই নির্মিত হচ্ছে নির্দিষ্ট দেশের, শ্রেণির, ভাষার দর্শকদের জন্য নয়, বরং বিশ্বের দর্শকদের জন্য। বাংলাদেশের মানুষ তাই বাংলাদেশি, ভারতীয় বা মার্কিন কনটেন্ট ছাড়াও ঝুঁকেছে কোরিয়া, জাপান, ইতালি, স্প্যানের চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজ আর গানের প্রতি।
একটা দ্রুতগতির ইন্টারনেট–সংযোগ আর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অ্যাকাউন্ট থাকলেই হাতের মুঠোয় চলে আসছে দেশি-বিদেশি হাজারো কনটেন্ট। আবার প্রতিটি প্ল্যাটফর্মেই পুরোনো আর ক্ল্যাসিক প্রযোজনার পাশাপাশি থাকছে তাদের নিজস্ব মৌলিক কনটেন্ট। একেকটি প্ল্যাটফর্ম কিছু কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলছে সবার কাছে।
হলে সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে কত রকম ঝক্কি-যানজট ঠেলে হলে যাওয়া, টিকিট কাটা বা নির্দিষ্ট শোর সময় মেনে সিনেমা দেখার বাধ্যবাধকতা। এই সব ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো। বিশেষ করে তাদের মৌলিক প্রযোজনাগুলো। ডিজিটালভাবে মুক্তি পাওয়া মাত্রই একযোগে সেসব দেখার সুযোগ পাচ্ছেন সারা বিশ্বের দর্শক।
টিভি সিরিজের ক্ষেত্রেও এসেছে বড় পরিবর্তন। সপ্তাহজুড়ে অপেক্ষায় থেকে একটি একটি করে নতুন পর্ব দেখার দিন শেষ। এমন বার্তাই দিচ্ছে নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো। কোনো অপেক্ষার বালাই নেই, মুক্তির দিনেই সব এক বসায় দেখে ফেলার সুযোগ আছে এই প্ল্যাটফর্মে। ফলে গ্রাহকেরা শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, জ্যামে থেমে, চলন্ত গাড়িতে যখন সময় মিলছে, টপাটপ দেখে ফেলছেন প্রিয় ধারাবাহিকের একেকটা পর্ব।
একেকটা অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম দর্শকদের দিয়েছে বিনোদনের স্বাধীনতা, অর্থাৎ স্বাধীনভাবে বিনোদন বেছে নেওয়ার সুযোগ। কেবল আলংকারিক নয়, আক্ষরিক অর্থেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস বা ব্রিটিশ লাইব্রেরির মতো; যেখানে ঢোকার সুযোগ করে নিতে পারলেই পুরো রাজ্যের বিনোদন চলে আসে নাগালে। এত পদের কনটেন্ট দেখে আপনি দ্বিধাগ্রস্ত? বুঝতে পারছেন না কী দেখবেন? কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন? কোনো সমস্যা নেই। রেটিং দেখুন। বা পছন্দের ঘরানা বেছে নিয়ে একটি একটি করে দেখতে থাকুন। ভালো না লাগলে বাদ। অন্য আরেকটি চালু করুন। জোর করে কেউ কিছু গেলাবে না আপনাকে। এভাবেই বিনোদন গ্রহণের ক্ষেত্রে সময় এবং স্থানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো।
বিশ্বের আর সব দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কদর বেড়েছে ডিজিটাল স্ট্রিমিং সাইটের। ‘হইচই’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘বঙ্গ’, ‘আইফ্লিক্স’ কিংবা ‘জি–ফাইভ’-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রমেই দখল করে নিচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোর জায়গা। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন বিভ্রাট আর সময়ের বাধ্যবাধকতামুক্ত থাকায় দেশীয় দর্শক ক্রমেই ঝুঁকছেন ডিজিটাল মাধ্যমে।
বাংলাদেশি দর্শকদের জন্য এই দেশে কার্যালয় খুলেছে কলকাতাভিত্তিক ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হইচই। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য এই অ্যাপ। বাংলাদেশের মেধাবী নির্মাতাদের কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতেই এখানে অফিস নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিছুদিন আগে হইচইয়ে মুক্তি পেয়েছে অমিতাভ রেজা চৌধুরী পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘ঢাকা মেট্রো’, যা সাড়া জাগিয়েছে দর্শকদের মধ্যে।
নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী স্ট্রিমিং সাইটগুলোকে দেখছেন নির্মাতাদের জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার হিসেবে। তিনি বলেন, ‘আগে একটা গল্প বলার অনেক বাধা ছিল। এখন গল্প বলার ধরনই বদলে গেছে। কোথায়, কার জন্য বানাবে, কে বিলিবণ্টন বা পরিবেশন করবে, কোথায় সেই কনটেন্ট বিক্রি হবে, এসব ভাবনা থেকে নির্মাতার মুক্তি মিলেছে। বড় স্টুডিও, বড় প্রযোজনা বা বড় ডিস্ট্রিবিউশনের দরকার নেই। যাঁরা নতুনভাবে ছবি বানাতে চান, তাঁদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম একটা বড় সুযোগ। আর সবচেয়ে বড় কথা, সিনেমার বাজার যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের হাতে আর নেই সিনেমা।’
সম্প্রতি শেষ হয়েছে হইচই-এর ‘মানি হানি’র প্রথম সিজন। এটা ছিল এই প্ল্যাটফর্মের দ্বিতীয় অরিজিনাল সিরিজ। তানিম নূর ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ওয়েব সিরিজটি প্রথম সিজনেই করেছে বাজিমাত। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ক্রাইম থ্রিলারটি পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এগুলো ছাড়াও হইচইয়ের ঝুলিতেও রয়েছে নতুন-পুরোনো অসংখ্য চলচ্চিত্র। এই প্ল্যাটফর্মটির মাসিক নিবন্ধন ফি মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে। বাংলাদেশ থেকে দর্শকেরা ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও ডিজিটাল ওয়ালেট ছাড়া অফলাইন সাবস্ক্রিপশন স্ক্র্যাচ কার্ডের মাধ্যমে হইচই সাবস্ক্রাইব করতে পারবেন। অফলাইন কার্ড পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার মীনাবাজার ও গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ারের সব আউটলেটে।
হইচই বাংলাদেশের বিজনেস লিড সাকিব আর খানের মতে, ‘পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে। আর আমরা বাংলা ভাষাকে ভাগ করতে রাজি নই। আমরা মানুষের সঙ্গে কথা বলে কনটেন্ট বানাই। আমরা মানুষের পছন্দ বুঝতে চাই। “ঢাকা মেট্রো” ওয়েব সিরিজটা বিশেষ করে কলকাতার মানুষেরা খুব পছন্দ করেছে। অন্যদিকে “মানি হানি” সিরিজ অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন কনটেন্ট মুক্তি পাচ্ছে। আমরা মনে করি, মানুষ মোটেই বোকা না। তাই মুক্তবাজারের মতো সবচেয়ে ভালো কনটেন্টই দিন শেষে জয়ী হবে। কোনো সিন্ডিকেটের সুযোগ নেই। সবচেয়ে পরিশ্রমী, মেধাবী নির্মাতা আর শিল্পীরাই টিকে থাকবে।’
মার্থা খ্রিস্টিনা গমেজ বিনোদনের জন্য নেটফ্লিক্সের ওপরই নির্ভরশীল। তাঁর মতে, নেটফ্লিক্স খুবই ব্যবহার উপযোগী। মাসে ৪৫০ টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট পাওয়া যায় এখানে। নেটফ্লিক্সের কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। সব এইচডি রেজল্যুশন। যেখানে দেখা শেষ করে বন্ধ করেছি, সেখান থেকেই আবার প্লে করা যায়। কনটিনিউ ওয়াচিং নামে ওই সব মুভির একটা আলাদা লিস্ট বানিয়ে রাখে নেটফ্লিক্স। একটা সিনেমা দেখলে, রুচি, পছন্দ অনুসারে ওই ধরনের সিনেমার তালিকা করে রাখে। তবে সমস্যা একটাই, বেশির ভাগ পুরোনো ছবিগুলো নেই এখানে। আবার নতুন ছবিগুলোও আপলোড হতে দেরি হয়। তবে সব মিলিয়ে নেটফ্লিক্স খুবই স্টাইলিস্ট।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহমেদ সেজানের অভিজ্ঞতাও অনেকটা একই রকম। তাঁর মতে, দ্রুতগতির ইন্টারনেট–সংযোগ থাকলে এগুলোর ব্যবহার খুব আনন্দের। তিনি স্বল্প স্টোরেজের মোবাইল ব্যবহার করেন। তাই ডাউনলোডের ঝামেলা ছাড়াই যেকোনো কনটেন্ট দেখার ক্ষেত্রে এই প্ল্যাটফর্মগুলো খুবই সহায়ক। এসব ছাড়াও রয়েছে অনলাইন মুভি ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, আমাজন প্রাইম বা এইচবিওর মতো অনলাইন টিভি চ্যানেল। স্মার্ট টিভিতে এই অ্যাপসগুলো ইনস্টল করা যায়। তবে এখানেও কনটেন্ট দেখার ক্ষেত্রে রয়েছে বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা।
বেসরকারি কর্মকর্তা জেইন মাহবুবের স্মার্ট টিভিতে নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, আইফ্লিক্স এবং জি-ফাইভ নেওয়া। তবে তিনি নেটফ্লিক্সেই মোটামুটি সব পেয়ে যান। তাই এই স্ট্রিমিং সাইট তাঁর মতে ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’। আর জি-ফাইভের খরচ খুবই কম। মাত্র এক দিনের জন্যও নেওয়া যায়। টিভির কোনো চ্যানেল তাই আর দেখা হয় না। কারণ টিভির সিরিয়ালগুলো তো আর তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে না। তাঁর ভাষায়, ‘সিরিয়ালের সঙ্গে আমার সময় মানিয়ে চলতে হয় না। এই প্ল্যাটফর্মগুলোর সিরিয়ালই আমার সময়ের সঙ্গে বেশ মানিয়ে চলে। তাই কেন নয়?’
বিনোদন নিয়ে কেবল দর্শকের রুচির পরিবর্তনই নয়, নির্মাণ আর বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত সবার ক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন এনেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। তরুণ একজন নির্মাতার এখন আর টিভিতে ভালো স্লট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন আর হল পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত নন। প্রযোজকেরাও লগ্নির অর্থ নিয়ে এখন বেশ স্বস্তিতেই আছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রসারে। লাভের গুড়ে ভাগ বসানোর সুযোগও নেই মধ্যস্বত্বভোগীদের।
পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুব সত্যি। সেই সত্যি মেনে সময়ের সঙ্গে সবকিছুই বদলে যায়। বদলে যায় বিশ্ব আর বিশ্বের সবকিছু। বদলে যায় মানুষের জীবন, জীবনযাপন, দর্শক আর দর্শকদের রুচি। আর সবকিছুর সঙ্গে অবধারিতভাবে বদলে যায় বিনোদন। পরিবর্তিত এই বিনোদনজগতে মানুষ যে আগের চেয়ে স্বাধীন ও সহজভাবে বিনোদন পাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতি মুহূর্তে ওপরের দিকে উঠতে থাকা জনপ্রিয়তার পারদই নীরবে চিৎকার করে তার প্রমাণ দিচ্ছে।