‘যত দিন সম্ভব হবে আপনাদের শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা যেন থাকে। একমাত্র এই চর্চা থাকলেই আমরা জঙ্গিবাদকে ভুলে যাব। মানুষের মতো মানুষ হতে পারব।’ কথাগুলো মুক্তিযোদ্ধা, বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ও ঢাকা-১৭ আসনের সাংসদ আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের। রাজধানী ঢাকার হোটেল ওয়েস্টিনে ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক এবং প্রথম শিশু চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’-এর পরিচালক ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার এ বছর পেয়েছেন শফিউজ্জামান খান লোদী ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। আজ শনিবার দুপুরে ঢাকার পাঁচতারা হোটেলে অতিথিদের কাছ থেকে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন তাঁরা। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হাতে উত্তরীয়, ক্রেস্ট ও পুরস্কারের অর্থমূল্য তুলে দেন আকবর হোসেন খান পাঠান ফারুক, আনোয়ারা সৈয়দ হক ও সুজাতা।
ফজলুল হকের অবদানের কথা বলতে গিয়ে ফারুক বলেন, ‘পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর আমাদের চলচ্চিত্র বানানোর কোনো অধিকার ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালে প্রাদেশিক পরিষদে বিল উত্থাপন করে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিল পাস করিয়ে আনেন। তখন কিন্তু ওই সংসদে একটা কথা উচ্চারিত হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র বানানোর কোনো পরিবেশ নেই। পাল্টা উত্তরে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আপনারা ভুল করছেন। আসলে আমাদের শিল্পী, কলাকুশলী, সবই আছে। আছে যোদ্ধাও। এখনই তো সময় পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র বানাবার।” এই যে কথাগুলো তিনি বলেছিলেন এবং বিল পাস করিয়ে এনেছিলেন, এর পেছনে কিন্তু হক সাহেবদেরই (ফজলুল হক) অবদান সবচাইতে আছে। এই অবদানের কথা স্মরণ করতেই হবে। শ্রদ্ধাভরে মনে রাখতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে পারব।’
সময়টা ৫০-এর দশক। তখনো চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়নি এ দেশে। ওই সময় মফস্বল শহর বগুড়া থেকে ‘সিনেমা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন ফজলুল হক। পত্রিকাটি ছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক মাসিক সাময়িকী। সেই সূত্রে এ দেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ফজলুল হক। শহিদুল আলম সাচ্চু পরিচালিত ফজলুল হকের জীবনীনির্ভর ডকুফিল্ম ‘দ্য ফ্রন্টিয়ার ম্যান’ সম্মুখযাত্রী ফজলুল হক দেখানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কারের ১৫তম আসর।
সংস্কৃতিজগৎ কিন্তু ছোট না, এটা অনেক বড় পৃথিবী। শুধু সিনেমা দিয়ে একজন পরিচালক পৃথিবীর দিকে আঙুল তুলে বলতে পারেন, দেখেছ? যে বিষয়টা অন্য কোনো উপায়ে দেখানো যায় না, তা শুধু চলচ্চিত্র দিয়েই দেখানো সম্ভব বলে মনে করেন সাংসদ ও বরেণ্য অভিনেতা ফারুক। তাঁর মতে, ‘হয় না এমন কোনো জিনিস চলচ্চিত্রে নাই। সে কারণেই আমরা বলে থাকি, পৃথিবীর সবচাইতে বড় গণমাধ্যম চলচ্চিত্র। আমাদের সেই চলচ্চিত্র কোথায় যেন ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছে। সে কারণে সাগরের (ফরিদুর রেজা সাগর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক চ্যানেল আই) মতো মানুষদের বলব, আরেকটু গভীরে যাও। আরও চলচ্চিত্র বানানোর চেষ্টা করো। আমি মনে করি, আমরা যারা সংস্কৃতি জগতের, তারা সবাই ভালোবাসার পৃথিবীর মানুষ। আমরা একে অপরকে ভালোবাসব। কী করে পথ দেখানো যায়, তা করব। সোনার বাংলা গড়ব।’
ফজলুল হকের সহধর্মিণী প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উদ্যোগে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। ২০০৪ সালে প্রবর্তিত এ পুরস্কার ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী ২৬ অক্টোবর অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এ বছর নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠানটি হয়নি, তাই আজ ১২ জানুয়ারি পুরস্কারপ্রাপ্ত লোকজনের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আলী ইমাম, ইমদাদুল হক মিলন, মামুনুর রশীদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, অরুণা বিশ্বাস, রিয়াজ, ওমর সানি, সানাউল আরেফীন, তিশা, কোনাল, আমীরুল ইসলাম, আসলাম সানী, শহীদুল আলম সাচ্চুসহ ফজলুল হকের পরিবারের সদস্য ফরিদুর রেজা সাগর, ফরহাদুর রেজা প্রবাল, কেকা ফেরদৌসী, কণা রেজা প্রমুখ।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের ফাঁকে গান পরিবেশন করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। অনুভূতি জানিয়ে লোদী বলেন, ‘ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্তি আমার চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে অন্যতম। আমি খুব গর্ব বোধ করছি এই পুরস্কার পেয়ে। যাঁরা আমাকে এই পুরস্কারটির জন্য মনোনীত করেছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
ফারুকী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘এই পুরস্কার একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার নামে প্রবর্তিত। একজন নির্মাতা হিসেবে এমন প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে অনেক গর্বের।’