আজ ঈদে মুক্তি পাওয়াপূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী নিয়ে কিছু কথা বলছি।
ছবির গল্পে মাসুদ পারভেজ ছিলেন সূত্রধর। কানাডাযাত্রী মাসুদ পারভেজ। ববিতাও যাবেন কানাডা। তাঁর একমাত্র ছেলে অনিকের উচ্চ ডিগ্রি সম্মাননা উৎসবে। ফ্লাইট বিলম্বে দুই তারকার পরস্পর দেখা।
গল্পের সারাংশে, নায়করাজ রাজ্জাক, তাঁর স্ত্রী আনোয়ারাসহ মেয়ের ঘরের নাতনি মিমো, ছেলের ঘরের নাতি শাকিব খান। সুখের সংসার। যথারীতি বার্ধক্য এবং মৃত্যুভীতির তাড়নায় মিমো এবং শাকিব খানের বিয়ে ঠিক করেন রাজ্জাক। বধূ সাজে মিমো সিঁড়ি দিয়ে নামতে রাজ্জাকের দৃষ্টিতে মিমো হয়ে যান দিতি। বুকের যন্ত্রণায় রাজ্জাক কাতর হয়ে পড়েন। কষ্টের কাঁটা জেগে ওঠে। গল্প পেছনে চলে যায়। ফ্ল্যাশব্যাক। দিতি ছিলেন রাজ্জাকের মেয়ে। প্রেম করে বসেন লজিং মাস্টার সুব্রতের সঙ্গে। একদিন পিতার অবাধ্য হয়ে দিতি ঘর ছেড়ে চলে যান। প্রায় দুই যুগের বিচ্ছেদকাল। শাকিব খানের জানা হয় পেছনের গল্পটি। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সার্চ করে শাকিব খান জানতে পারেন ফুফু দিতি মালয়েশিয়ায় থাকেন। শাকিব খান মালয়েশিয়া চলে আসেন। ফুফুকে (দিতি) খুঁজতে এসে জয়া আহসানকে পেয়ে যান। জয়ার পয়েন্ট অব ভিউ হতে আরিফিন শুভ পর্দায় এসে যান। তিনকোণ প্রেমে-অপ্রেমে গল্প এগোতে থাকে। আরিফিন শুভ বুঝতে পারেন তাঁর একতরফা প্রেম। দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। গল্পের কেন্দ্র তথা রাইজিং পয়েন্টে শাকিব খানের ট্যাক্সি দুর্ঘটনা। চিত্রনাট্যের দাবিতে গল্পটি শীর্ষ বিন্দু থেকে পতনমুখী হওয়া। জয়া আহসান এবং সুব্রতের সেবা-চিকিৎসায় শাকিবের সুস্থ হয়ে ওঠা। অতঃপর জয়া আহসানের বাড়িতে আশ্রয়। এবার গল্পের জট খোলা। শাকিব খান জানতে পারেন, তাঁর আশ্রয়দাতা জয়া আহসানের পিতা সুব্রত এবং মা দিতি তাঁর ফুপা-ফুপু। আর বোনাস হিসেবে পাওয়া ফুপু-কন্যা জয়া আহসান। দুই ঘণ্টা ৩৮ মিনিটের পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী এখানেই শেষ হয় না। নায়ক থেকে খলনায়ক আরিফিন শুভর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু। জয়া আহসানকে পেতে দিতি ও সুব্রতকে রিভলবার দেখিয়ে হুমকি। এবং খুন করে ফেলা! শাকিব খান, কিছুক্ষণ পরে জয়া আহসানের আগমন। শাকিবের হাতে রিভলবার দেখে জয়া আহসান হতবিহ্বল! শাকিব খান জয়া আহসানকে নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
গল্পের শুরুতে রাজ্জাকের পরিচিতি দৃশ্যের পটভূমিতেই পাওয়া যায় বাকরুদ্ধ জয়া আহসান এবং শাকিব খানকে। সেই ভোর-সকাল। প্রাতর্ভ্রমণ। ডাব কেটে খাওয়া। এখানেও আরিফিন শুভর উদয়। নায়ক-খলনায়কের মল্লযুদ্ধ। জয়া আহসানের মাথায় আঘাত। জয়া আহসানের স্মরণ স্মৃতি ফিরে আসা। ডাব কাটা চাকু দিয়ে শাকিব খানকে জয়া আহসানের আঘাত করা। গল্পের অন্তিম বিন্দুতে আবার উত্তেজনা। শাকিব খান ও জয়া আহসান সুস্থ হয়ে উঠলেন। আরিফিন শুভ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বেঁচে রইলেন। পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী শেষ হলো।
দৃশ্য অভিনয়ে সব চরিত্রই স্বাভাবিক আচরণশিষ্ট। কৌতুকরস সৃষ্টিতে সাজু খাদেম ভাঁড়মুক্ত। দর্শকদের বিবেচনায় জয়া আহসান এবং আরিফিন শুভ সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে ছিলেন। ‘কানে লাগে’ সংলাপ উচ্চারণ, এবং ট্যাক্সি ক্যাবের ওপর দাঁড়িয়ে একক নাট্য অভিব্যক্তি প্রকাশে আরিফিন শুভ প্রশংসনীয়। আবহ সংগীত রচনায় আরও মনোযোগের প্রয়োজন ছিল। জয়া আহসানকে নিয়ে দুই নায়কের থিম সংগীত আর পার্থক্য ভিন্নতা দাবি করেছিল। গীত-শব্দ রচনায় কবির বকুল নিজের শব্দশক্তির প্রমাণ রেখেছেন। চন্দন সিনহার কণ্ঠে ‘তুমি আছো বলে তারা নিভে জ্বলে’ গানটি প্রাণপ্রাচুর্যে গীত হয়েছে। প্রতিটি গানের দৃশ্য নির্বাচন ও কোরিওগ্রাফি থিমেটিক সৌন্দর্যের ডকুমেন্টেশন।
পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী সম্পাদনায় ট্র্যানজিশন বা প্যারাফ্রেজের স্বল্প ব্যবহারে গল্পের দৃশ্য ও গতিছন্দ সরলভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন সম্পাদক। তবে জয়া আহসানের দৃষ্টিকোণ থেকে শাকিব খানের (ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড) দুর্ঘটনা দৃশ্য কাহিনির সাংগঠনিক সুসংবদ্ধতা নষ্ট করেছে। সম্পাদক ভুলে গিয়েছিলেন তাঁর কাজটি ছিল কাহিনিকে সুবিন্যস্ত সুশৃঙ্খল করে বর্ণনা করা। তবে শব্দ, সংলাপ থেকে ম্যাচ কাটিং চমৎকার। দিতির সংলাপ (জয়াকে বলা) ‘তোকে কেউ বাংলাদেশে নিয়ে যাবে’ কাট করে শাকিব খানের হেঁটে আসা প্রশংসনীয়।
মালয়েশিয়ার নগর দৃশ্যের সঙ্গে হাতিরঝিলের বক্রসেতু দেখে দর্শক হোঁচট খেলেও চিত্রগ্রাহকের ট্রলি শটের ছান্দিক ব্যবহার দর্শকদের দৃষ্টি সুখের স্বাদ দিতে পেরেছে।
পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনীর চলচ্চিত্রের সব শিল্পীর পোশাক অঙ্গসজ্জা চরিত্রের সঙ্গে মানানসই ছিল। শুধু মা চরিত্রে আনোয়ারার পরাচুল দৃষ্টিকটু লেগেছে। জয়া আহসান স্নিগ্ধ রুচিতে বিশ্বাস করেন বিধায় মুখমণ্ডলে চড়া মেকাপ পরিহার করতে পারতেন। শুধু একটি দৃশ্যে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ব্যবহার করে দর্শকদের দৃষ্টিভাবনাকে নাড়িয়ে দিতে পারতেন। বহুদিন পর শাকিব খানের আঙ্গিক-বাচিক অভিব্যক্তির সঙ্গে পোশাক নির্বাচন দৃশ্যত মানানসই মনে হয়েছে।
একটি শট কম্পোজিশনের কথা বলা যায়। গল্পের শেষাংশে মাসুদ পারভেজ ও ববিতা বিমানবন্দর লাউঞ্জে বসা। সূত্রধর মাসুদ পারভেজ গল্পটির পরিণতি টানছেন। দুজন শিল্পীই ক্যামেরা ফোর গ্রাউন্ডে বসা। তাঁদের পেছন সিটে অতি সাধারণ ভূষণে কিছু যাত্রী। যাঁদের উপস্থিতি সম্পূর্ণ শটের অর্থ-ব্যঞ্জনা এবং জ্যামিতিক ভারসাম্য খর্ব করেছে। এর সঙ্গে ববিতার চুলে গোঁজা তাল সাইজ রঙিন ফুল উৎকট মনে করার বিষয় ছিল।
ফ্রেন্ডস মুভিজ ইন্টারন্যাশনাল প্রযোজিত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। দর্শকের মনে কৌতূহল থেকে যাবে। একজন সাধারণ লজিং মাস্টার কার অর্থে ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করল? শুধু ডাক্তারি পেশায় কত উপার্জন করে রাজপ্রাসাদসম অট্টালিকার মালিক হয়ে গেল? গল্পরসের শেষ বিন্দুটুকু অতিনাটকীয় সিচুয়েশনকে বিনির্মাণ করেন পরিচালক। হঠাৎই জয়া আহসানকে দিয়ে শাকিব খানকে ছুরিকাহত করলেন। আরিফিন শুভর রিভলবারের গুলিতে দিতি, সুব্রতকে নিথর করে দিলেন। ব্রেন অস্ত্রোপ্রচারে জয়ার মস্তিষ্ক থেকে টিউমার অপারেশনও সমাপ্ত করলেন। গল্পটির মধুর মিলন প্রয়োজনে এবং অলৌকিকভাবে দিতিও বেঁচে উঠলেন। পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী সফল হলো। সব সম্ভব হলো চিত্রনাট্যকারের উর্বর মস্তিষ্কের ফলনে।