পর্দায় যেমন দেখাতেন তেমন ছিলেন না

একটা সময় শুধু খল অভিনেতা হিসেবেই পর্দায় নিজেদের আলাদা ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিলেন কয়েকজন অভিনেতা। নিজেদের ব্যক্তিপরিচয়কে ছাপিয়ে, তাঁদের শিল্পীপরিচয়টিই হয়ে উঠেছিল সবার কাছে প্রিয়। দর্শক যখন সিনেমা দেখতেন, তাঁদের চরিত্রকে দেখে ঘৃণায় ভরা বাক্যবাণ ছুড়ে দিতেন। কিন্তু পর্দার বাইরে এই খল অভিনেতারাই ছিলেন অনেকের আদর্শ। অনেক ভক্ত এই ‘ভিলেন’–দের দেখেই হয়ে যেতেন আবেগে আপ্লুত। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় এই খলনায়কেরা বাস্তবে পরিবার আর ভক্তদের কাছে কেমন ছিলেন, সেটাই জানাচ্ছেন প্রতিবেদক মনজুরুল আলম।
পরিবারের সঙ্গে খলিল উল্লাহ্‌ খাঁ
পরিবারের সঙ্গে খলিল উল্লাহ্‌ খাঁ

খলিল (১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪—৭ ডিসেম্বর ২০১৪)
পুরো নাম আবুল ফজল মোহম্মদ খলিল উল্লাহ্‌ খাঁ। চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগেই খলিলকে পাওয়া গেছে সম্ভ্রান্ত ধনীর পরিবারের কর্তা কিংবা গ্রামের প্রতাপশালী ব্যক্তির চরিত্রে, আদতে যার ভেতর থাকবে নেতিবাচক স্বার্থসিদ্ধির মনোবাসনা। ভদ্রবেশী কুচক্রী ব্যক্তি, অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা, লোভ দেখিয়ে মানুষকে ঠকানো, গ্রামের বখাটে যুবক, দুশ্চরিত্র মাতবর বা চেয়ারম্যান—এমন সব চরিত্রেও খলিল মানিয়ে যেতেন বেশ। তাঁর কথা বলার ধরনের জন্যও তিনি দর্শকদের কাছে ‘খল খলিল’ হিসেবে পরিচিত পান। নবাব সিরাজউদ্দোলা ছবিতে মিরজাফরের চরিত্রে অভিনয় করে খলিলকে ভক্তদের কাছে শুনতে হয়েছে—‘ওই দেখ মিরজাফর যায়।’ ৪ মেয়ে, ৫ ছেলের বাবা তিনি। তাঁর ছেলে খালেদ খান জানান, ‘দর্শক বাবাকে চলচ্চিত্রে নেতিবাচক চরিত্রে দেখলেও সেটা অভিনয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাস্তবে তিনি ছিলেন নায়ক। পরিশ্রমী আর বিনয়ী মানুষ।’ খলিল ১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। একুশে পদক, ২০১২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (আজীবন সম্মাননা) পান তিনি। খলিল আর্মি অফিসার থেকে আনসারে অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯৯২ সালে অবসর নেন। তাঁর স্ত্রীর নাম রাবেয়া খানম। ১৯৫৯ সালে জহির রায়হান নির্মিত সোনার কাজল ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন খলিল উল্লাহ্‌ খান।

ছেলের সঙ্গে রাজীব

রাজীব (১ জানুয়ারি ১৯৫২—১৪ নভেম্বর ২০০৪)

বাংলা চলচ্চিত্রে ওয়াসীমুল বারী রাজীব ছিলেন এক অনবদ্য খল অভিনেতা। তাঁর গম্ভীর ঝাঁজালো কণ্ঠ, রহস্যভরা চোখের চাহনি, বৈচিত্র্যময় অভিব্যক্তি যেমন দর্শককে দিত টান টান উত্তেজনা তেমনি করত আতঙ্কিত। খল অভিনেতা রাজীব চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। পর্দায় খলনায়ক হলেও পরিবার, সন্তান, ভক্ত, সহকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন মিশুক, হাস্যোজ্জ্বল আর আড্ডাবাজ এক মানুষ। রাজীবের দুই মেয়ে (রানিসা রাজীব ও রাইসা রাজীব) আর এক ছেলে (সায়নুল বারী দ্বীপ)—কেউই এখন ঢালিউডের সঙ্গে যুক্ত নন। এ অভিনেতার ছেলে বলেন, ‘বাবা চলচ্চিত্র নিয়ে বাসায় কখনো কথা বলতেন না। বাবার পারিবারিক জীবন আর চলচ্চিত্রজগৎ আলাদা ছিল। খোলা মনের একজন সাদামাটা মানুষ ছিলেন আমার বাবা।’ মার্শাল আর্টের ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের চাচাতো বোন ইসমত আরাকে বিয়ে করেন রাজীব। জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘সিনেমায় দেখানো চরিত্রগুলো থেকে বিপরীত ছিলেন রাজীব। শুটিং সেটে কখনো উচ্চস্বরে বা চড়া মেজাজে কথা বলতেন না।’ ১৯৮২ সালে কাজী হায়াতের হাত ধরে খোকন সোনা ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। ২২ বছরের ক্যারিয়ারে চার শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজীব। ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি পটুয়াখালীতে তাঁর জন্ম। ২০০৪ সালে ১৪ নভেম্বর ৫২ বছর বয়সে ক্যানসারে মারা যান এই শক্তিমান অভিনেতা।

পরিবারের সঙ্গে মিজু আহমেদ

মিজু আহমেদ (১৭ নভেম্বর ১৯৫৩—২৭ মার্চ ২০১৭)

মিজানুর রহমান চলচ্চিত্রে নাম লিখিয়ে হয়ে যান মিজু আহমেদ। এই অভিনেতা ভক্তদের মুখোমুখি হতে ভয় পেতেন। একবার নাকি ফেরি পার হয়ে ভক্তদের মুখোমুখি পড়ে যান অভিনেতা মিজু আহমেদ। গাড়ির সামনে ভক্তরা দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে বসেন প্রিয় খল অভিনেতার মুখ থেকে সরাসরি গালি শুনবেন! পরে উপায় না পেয়ে মিজু আহমেদ ভক্তদের ‘হালকা ঝাড়ি’ শোনান। আর তা শুনে ভক্তরা খুশিতে করতালি দিতে শুরু করেন। এমনই ছিল খল অভিনেতা মিজু আহমেদের জনপ্রিয়তা। চরিত্রের প্রয়োজনে ছবিতে অশালীন শব্দ ব্যবহার করে সংলাপ বলতে হতো মিজু আহমেদকে। কিন্তু বাস্তব জীবনে তিনি নাকি কখনোই কোনো আপত্তিকর কথা মুখে আনতেন না, স্বভাবে ছিলেন স্বল্পভাষী। তাঁর স্ত্রী পারভিন আহমেদ বলেন, ‘তাঁর মতো স্বামী পাওয়া আমার জন্য সৌভাগ্যের।’ দুই মেয়ে তাসনিম আহমেদ, আফিয়া আহমেদ ও ছেলে হারসাত আহমেদের আদর্শ তাঁদের বাবা মিজু আহমেদ। বড় মেয়ে তাসনিম একটি ব্যাংকে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা মুখে কোনো দিন কোনো বাজে কথা তো দূরে থাক, কখনো আমাদের সামনে কাউকে “তুই” বলেও সম্বোধন করেননি। এতটাই স্বল্পভাষী ছিলেন যে বোঝাই যেত না তিনি বাড়িতে আছেন নাকি নেই।’ শৈশব থেকেই থিয়েটারের প্রতি ঝোঁক ছিল মিজু আহমেদের। ১৯৭৮ সালে তৃষ্ণা ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। দুবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি। ১৯৫৩ সালের ১৭ নভেম্বর মিজু আহমেদ কুষ্টিয়ায় জন্ম নেন। ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ তিনি হৃদ্‌রোগে মারা যান।

স্ত্রীর সঙ্গে নাসির খান

নাসির খান (১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯—১২ জানুয়ারি ২০০৭)

বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনির পাশেই গলিটির নাম এখন ‘নাসির খানের গলি’। অভিনেতা নাসির খান স্ত্রী, তিন কন্যাসহ এখানে থাকতেন বলেই নাকি গলিটির এই নাম। যে বাড়িতে একসময় থাকতেন তিনি, এখনো নাকি অনেক উৎসুক ভক্ত সেই বাড়িতে গিয়ে নাসির খানকে দেখার চেষ্টা করেন। অনেকে মনে করেন এখনো বেঁচে আছেন তিনি। কিন্তু এই অভিনেতা তো পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন (ওয়ান–ইলেভেন) দেশের পরিস্থিতি ছিল সংকটাপন্ন। তাই নাসির খানের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে ততটা প্রচার হয়নি। এ কারণেই এখনো অনেকে ভাবেন এ শিল্পী বেঁচে আছেন। তা ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আলাদা করে নাসির খানকে স্মরণ করে না বলেও তাঁর না থাকার কথা জানে না অনেকেই। এ অভিনেতা পরিবারের কাছ থেকে জানা গেল, এফডিসিতে মিজু আহমেদের উদ্যোগে একবার স্মরণ করা হয়েছিল নাসির খানকে। মূলত খল চরিত্রে অভিনয় করেই নাসির জনপ্রিয়তা পান। এ অভিনেতা তিন কন্যাসন্তানের বাবা। নাসির খানের বড় মেয়ে নাছিমা খানম জানান, ‘বাবা সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করলেও বাস্তবে সহজ–সরল জীবন ছিল তাঁর। সবার খোঁজখবর রাখতেন। নিজের কাজটাকে ভালোবাসতেন।’

নাসির খানের মৃত্যুর সময় ছোট মেয়ে মহিমা খানমের বয়স ছিল মাত্র ১ বছর। মহিমা জানাল, ‘টিভিতে বাবাকে প্রতিদিন দেখছি কিন্তু বাবা বলে ডাকতে পারছি না, এটা আমার একটা চাপা কষ্ট।’ নাসির খানের জন্ম ১৯৫৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ২৭ বছরের অভিনয়জীবনে তিনি কাজ করেছেন প্রায় ৫০০ ছবিতে।