‘তলা’ ও ‘কলা’য় তাদের জন্ম—বকুলতলা এবং চারুকলা, মানে চারুকলার বকুলগাছতলায় জন্ম তাদের। নিজেরা বারবারই বলেন, ‘আমরা তো গাছতলায় গান করতে ভালোবাসি’; সেই গানের দল ‘জলের গান’–এর সঙ্গে আলাপ–সালাপ করতে আমরা যখন তাদের ধানমন্ডির স্টুডিওতে বসেছি, তখন চারপাশ থেকে ভেসে আসছে গানের কলকাকলি।
১৮ অক্টোবর শুক্রবারের ছুটির সকালটা গীতিময় হয়ে উঠেছিল জলের গানের বহুবর্ণিল কাকলিতে। সেখানে নানান গানের পাশাপাশি উঠে এল তাদের ১২ বছরের পথচলার হিসাব–কিতাব, এল ২৭ অক্টোবর প্রকাশিতব্য তাদের নতুন অ্যালবামের কথাও। আরও এল দলের প্রতিষ্ঠাতা কনক আদিত্য এখন দলে নেই কেন, তা নিয়েও খোলাখুলি কথাবার্তা।
কেন দূরে কনক?
জলের গান নিয়ে কথা শুরু হলে কনক আদিত্য তো আসবেনই। ২০০৬ সালে তিনি আর রাহুল আনন্দ মিলেই গড়ে তুলেছিলেন এই দল। তবে প্রায় বছর দুই আগে হঠাৎ একরকম বলে–কয়ে দল থেকে ছুটি নিলেন কনক। দল থেকে কেন ছুটি নিলেন তিনি?
নানা প্রসঙ্গের লতা বেয়ে গানে–কথায় ততক্ষণে আলাপ এগিয়েছিল অনেক দূর। কিন্তু আচমকা কনক প্রসঙ্গ আসতেই স্তব্ধ হয়ে গেল সব। দল থেকে কনকের দূরে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে পাছে লোকে যে সাত কথা বলে, তা অজানা নয় রাহুলেরও। মৃদু চাপাচাপিতে এবার তাই খোলাসা করেই বললেন তিনি—কনকের অভিন্নহৃদয় বন্ধু রাহুল আনন্দ, ‘মানুষের সামনে গান গেয়ে আর আনন্দ পাচ্ছিল না সে। তো, কী আর করা...ও আরও বছর দুই আগে থেকেই মঞ্চে আর গান করবে না, এমন বলছিল আমাকে, নানা সময়ে আমিই ওকে জোর করেছি, কিন্তু একসময় সে ছুটিই নিল। ও তো কেবল আমার গানের বন্ধু নয়, আমাদের সম্পর্ক আরও গভীরের। এই তো কয়েক দিন আগেই স্টুডিওতে এসে নতুন অ্যালবামের গানগুলো ধ্যান ধরে শুনল এবং ওর কিছু অবজারভেশন ও ইনপুটও দিল। ফলে নতুন অ্যালবামটি আমরা আবারও মাস্টার করিয়েছি।’
রাহুল যখন কথা বলছিলেন, দলের উৎসাহী এক সদস্য তখন নিজের মুঠোফোন থেকে আমাদের দেখালেন একটি ছবি—দলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছেন কনক। ওই ছবির দিকে কেবল চোখ রেখেছি আমরা, এর মধ্যে রাহুলের কণ্ঠস্বরে দীর্ঘশ্বাস, ‘আসলে কনক যে ছুটি নিল, এটা নিয়ে ওর প্রতি একধরনের অভিমান আছে আমার।’
বন্ধুর প্রতি বন্ধুর সেই অভিমানের আঁচ আমরাও টের পেলাম যেন।
জলের গানের ভেতরে এর মধ্যে ঘটেছে নানা অদলবদল। যুক্ত হয়েছেন একঝাঁক নতুন সদস্য। রাহুলের ভাষায়, ‘জলের গান একটি প্ল্যাটফর্ম, প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসার পর কিছু মানুষ যেমন সেই ট্রেনে ওঠে এবং নামে, এ দলটিও তেমন, এখন নতুন যাত্রী নিয়ে সামনের দিনের স্বপ্ন বুনছে।’ রাহুল আনন্দ, রানা সরোয়ার, এ বি এস জেম, মাসুম মিয়া, দীপ রায়, মল্লিক ঐশ্বর্য, গোপী দেবনাথ ও শব্দ প্রকৌশলী ডি এইচ শুভ—এঁদের নিয়েই এখন জলের গানের গানের সংসার। আর সেই সংসারে সবার ‘দাদা’ একজন ‘আর্টিস্টম্যান’—রাহুল আনন্দ।
জলের গানের অন্দরে
পুরো স্টুডিও নানা রকমের সংগীতযন্ত্রে ঠাসা। এগুলো দেখতে আমাদের চেনা–জানা যন্ত্রের মতো নয়, তবে গানেরই যন্ত্র এরা। নাম কী এদের?
‘ওটা লখাই, ওটা বেহুলা, এটা হারামনি, এটা পাগলি, আর ওই যে দেখছেন, ওটা হলো পদ্মা, তার পাশেরটা মমতা...।’
প্রশ্ন করতেই একে একে বিচিত্র সংগীতযন্ত্রের নাম বলে গেলেন জেম, জলের গানের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের একজন তিনি। যন্ত্রগুলো দেখতে দেখতে ঘরের দেয়ালে সাঁটা একটা ছবিতে স্থির হলো চোখ—রাহুল আনন্দর প্রতিকৃতি, পাশে লেখা ‘হতভম্ব আর্টিস্টম্যান আঁকতে পারে না।’
রাহুল গাইতে পারেন জানি, তবে চারুকলায় আঁকাজোকাতেই তো পড়াশোনা তাঁর, এখন কি তিনি আঁকেন?
প্রশ্নের জবাবটি রাহুল দিলেন সলজ্জ হাসি দিয়ে। সেখানে আঁকাআঁকির প্রসঙ্গও এল বটে, তবে নয়ন জলের গান নামে জলের গানের নতুন অ্যালবামের তোড়ে অন্য সব কথা যেন হালে পানি পেল না।
‘নয়ন জলের গান’
জলের গানের প্রকাশিত অ্যালবাম দুটি—‘অতল জলের গান’ ও ‘পাতালপুেবর গান’। আসছে রোববার মুক্তি পাবে তাঁদের নতুন অ্যালবাম ‘নয়ন জলের গান’। এখানে গান আছে ১২টি। এর মধ্যে ‘চন্দনী’ শিরোনামে একটি গান গেয়েছেন বারী সিদ্দিকী। রাহুল বললেন, ‘সম্ভবত এটাই গুরুজির রেকর্ড করা শেষ গান, অনিমেষ আইচের না মানুষ ছবির জন্য গেয়েছিলেন।’ আরও বললেন, ‘আমাদের এই অ্যালবাম আমার গুরু সংগীতজ্ঞ বারী সিদ্দিকীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, গানের এই কীর্তিমানকে গান দিয়েই শ্রদ্ধা জানাতে চাই আমরা।’
দলের নতুন সদস্য গোপী দেবনাথ আড্ডাচ্ছলে জানালেন নতুন একটি তথ্য, এই পুরো অ্যালবামের রেকর্ডসহ এর মিউজিক ভিডিও ধারণ করা হয়েছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় এক পাহাড়ের ওপর।
অ্যালবামটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তো থাকবেই। এ ছাড়া নয়ন জলের গান–এর সিডির সঙ্গে বরাবরের মতো জলের গান বের করছে একটি গানের খাতা। এবার পাওয়া যাবে গানের খাতার দ্বিতীয় সংস্করণ। এখানে তাদের সব গানের লিরিক এবং কর্ড বিভাজনও লেখা থাকবে। সিডি+খাতার দাম ১০০ টাকা। ফেসবুকে খুঁত–এর পেজ থেকে অ্যালবামটি অর্ডার করতে পারবেন যে কেউই। তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর তিন দিন। রোববার বেলা আড়াইটায় চ্যানেল আইয়ে এবং বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অব্দি এবিসি রেডিওতে গান গেয়ে অ্যালবামটি মুক্তি দেবেন তাঁরা। এরপর জলের গানের ‘নয়ন জলের গান’–এর আসর বসবে কোনো এক গাছতলায়।
কোন গাছতলায়?
রহস্য রাখলেন রাহুল আনন্দ, ‘এটা আপাতত সিক্রেটই থাক।’
● নয়ন জলের গান থেকে অপ্রকািশত গানের িকছু অংশের পরিবেশনা েদখুন প্রথম আলো অনলাইনে