নেটফ্লিক্সে মজবে আরব বিশ্ব?

আরব বিশ্বের জনগণকে আকৃষ্ট করতে স্থানীয়ভাবে তৈরি কনটেন্টের প্রচার শুরু করেছে নেটফ্লিক্স। লক্ষ্য একটাই, আরব অঞ্চলের বাজার দখল করা। ছবি: রয়টার্স
আরব বিশ্বের জনগণকে আকৃষ্ট করতে স্থানীয়ভাবে তৈরি কনটেন্টের প্রচার শুরু করেছে নেটফ্লিক্স। লক্ষ্য একটাই, আরব অঞ্চলের বাজার দখল করা। ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্য বা আরব বিশ্বে অনেক আগেই যাত্রা শুরু করেছে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং জায়ান্ট নেটফ্লিক্স। তবে এত দিন তাতে ছিল শুধুই বিদেশি ছবি ও সিরিজের জয়গান। এবার আরব বিশ্বের জনগণকে আকৃষ্ট করতে স্থানীয়ভাবে তৈরি কনটেন্টের প্রচার শুরু করেছে নেটফ্লিক্স। লক্ষ্য একটাই, আরব অঞ্চলের বাজার দখল করা।

চলতি মাসের ১৩ তারিখ আরবি ভাষায় ‘জিন’ নামের একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনাধর্মী সিরিজের প্রচার শুরু করেছে নেটফ্লিক্স। ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটটি এত দিন ইংরেজি বা অন্যান্য বিদেশি ভাষার ছবি ও সিরিজ দিয়ে আরব অঞ্চলে গ্রাহক টানার চেষ্টা করেছিল। এবার স্থানীয় গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হচ্ছে দেশি কনটেন্ট। অর্থাৎ আরব অঞ্চলের পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে ছবি তৈরি করা হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য, স্থানীয় গ্রাহকদের আকর্ষণ করা। আরব অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান বাজার দখল করতে চাইছে নেটফ্লিক্স।

আইএইচএস মারকিট নামের একটি গবেষণা সংস্থা জানাচ্ছে, আরব বিশ্বে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসা। বর্তমানে আরব অঞ্চলে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটগুলোর গ্রাহক প্রায় ১৮ লাখ। তবে গত বছর গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রস্ট অ্যান্ড সুলিভান বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের মোট জনসংখ্যার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ টেলিভিশনেই বিনোদন খোঁজেন। আর ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটের গ্রাহক ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ২০১৬ সাল থেকে নেটফ্লিক্স চালু আছে এই অঞ্চলে। এবার প্রতিষ্ঠানটি এই বাজার দখল করতে স্থানীয় ছবি ও সিরিজ তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। নিজেদের প্রকৃত গ্রাহকসংখ্যা না জানালেও এর মাধ্যমে নিজেদের বাজার অংশীদারত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে পারবে বলে মনে করে নেটফ্লিক্স।

তবে নেটফ্লিক্সের খালি মাঠে গোল দেওয়ার উপায় নেই। বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, নেটফ্লিক্সের মূল প্রতিযোগী হিসেবে আছে স্টারজ প্লে ও ওয়্যাভো নামের দুটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে স্টারজ প্লে আছে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে। এর আংশিক মালিকানা মার্কিন প্রতিষ্ঠান লায়নসগেটের। এই অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটের আছে প্রায় ১০ লাখ গ্রাহক। বর্তমানে হলিউডের ছবি ও সিরিজ দিয়েই দর্শক টানছে স্টারজ প্লে। তবে শিগগিরই আরবি ভাষায় তৈরি ছবি ও বলিউডের কনটেন্ট আনতে চলেছে এটি। স্টারজ প্লের মূল লক্ষ্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার দখলে নেওয়া। ওদিকে সৌদি মালিকানাধীন এমবিসি গ্রুপ নিজেদের ‘শহিদ’ ও ‘শহিদ প্লাস’ নামের ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটের কার্যক্রম জোরদারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে নেটফ্লিক্সকে।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, নেটফ্লিক্স এখন নিত্যনতুন স্থানীয় কনটেন্ট তৈরির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। মিসরে মোবাইল ফোনে ব্যবহার উপযোগী সাশ্রয়ী প্যাকেজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের বাইরে নেটফ্লিক্সের অবস্থা ততটা সুবিধার নয়। সেখানে স্টারজ প্লে রমরমা। এখন এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে নেটফ্লিক্স।

আরবি ভাষায় ‘জিন’ নামের একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনাধর্মী সিরিজের প্রচার শুরু করেছে নেটফ্লিক্স। ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য এরই মধ্যে ‘জিন’ নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে নেটফ্লিক্স। জর্ডানে এই সিরিজটি নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, এটি নাকি জর্ডানের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধবিরোধী। দেশটির গ্র্যান্ড মুফতি একে ‘নৈতিক অবক্ষয়’-এর বিষয় বলে অভিহিত করেছেন। জর্ডানের বিভিন্ন মন্ত্রী ও আইনপ্রণেতাও এই সিরিজের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। এমনকি নেটফ্লিক্স থেকে এই সিরিজ তুলে নেওয়ার দাবিও উঠে গেছে।

সংবাদমাধ্যম ফরচুন বলছে, সিরিজটিতে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিফলন দেখা গেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। বিশেষ করে মদ্যপান ও কিশোর-কিশোরীদের চুমু খাওয়ার দৃশ্য নিয়েই আপত্তি উঠেছে। যদিও নেটফ্লিক্স আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলেছে, জর্ডানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিরোধী কিছু দেখানোর উদ্দেশ্য তাদের নেই এবং এই সিরিজের মধ্য দিয়ে আরব অঞ্চলের তরুণ সম্প্রদায়ের জীবনের একটি রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে এতে প্রতিবাদের আগুন নিভছে না। জর্ডানের গণমাধ্যম বিশ্লেষক সাদ হাতার বলছেন, আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আধুনিক চিন্তাভাবনায় নিজেদের কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখে জর্ডান। তবে আদতে পরিস্থিতি তেমন নয়। দেশটিতে প্রচারিত হলিউডের অনেক ছবিতেই এসব বিষয় দেখানো হয়ে থাকে। কিন্তু যখন তা স্থানীয়ভাবে তৈরি সিরিজে দেখানো হচ্ছে, তখনই প্রতিবাদের ঝড় উঠছে।

‘জিন’ সিরিজের কলাকুশলীরা। ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য প্রতিবাদের তোড়ে পিছু হঠতে চাইছে না নেটফ্লিক্স। খালিজ টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেটফ্লিক্স এরই মধ্যে আরবি ভাষায় আরও দুটি ছবি বা সিরিজ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে ‘আল-রাওয়াবি স্কুল ফর গার্লস’ তৈরি হচ্ছে আরব অঞ্চলের নারীদের জীবনকে উপজীব্য করে। এ ছাড়া ‘প্যারানরমাল’ নামের আরেকটি আধিভৌতিক সিরিজ তৈরিও চূড়ান্ত হয়ে গেছে।

রক্ষণশীল আরব সমাজের বিক্ষোভ ঠেলে নেটফ্লিক্স কতটুকু এগোতে পারবে, তা বলা মুশকিল। এটি ঠিক যে আরব বিশ্বের বাজার পুরোপুরি দখল করতে পারলে আখেরে নেটফ্লিক্সেরই লাভ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে আপসও করতে হতে পারে। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলায় এরই মধ্যে নেটফ্লিক্সকে ‘প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট উইথ হাসান মিনহাজ’ নামের জনপ্রিয় কমেডি শোয়ের একটি পর্ব সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। সৌদি আরব রাষ্ট্রীয়ভাবে এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। তাতেই আত্মসমর্পণ করে নেটফ্লিক্স।

সামনের দিনগুলোয় এমন আপত্তি যে আরও বাড়বে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? কারণ, এসব সমস্যা এক দিনে সমাধান হওয়ার নয়।