‘শূন্য’ উদ্বোধন করেন পাঠশালা ও ছবি মেলার প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, উৎসব পরিচালক তানজিম ওয়াহাব, নির্বাহী পরিচালক এএসএম রেজাউর রহমান ও কিউরেটর সরকার প্রতীক
‘শূন্য’ উদ্বোধন করেন পাঠশালা ও ছবি মেলার প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, উৎসব পরিচালক তানজিম ওয়াহাব, নির্বাহী পরিচালক এএসএম রেজাউর রহমান ও কিউরেটর সরকার প্রতীক

নানা শিল্পকর্মে পূর্ণ ছবিমেলা ‘শূন্য’

নতুন স্বাভাবিক সময়ে নতুন অভিজ্ঞতায় শুরু হলো এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ আলোকচিত্র উৎসব ছবিমেলা। ছবিমেলা একে ১১তম আসর না বলে বরং বলছে করোনাকালীন বাস্তবতায় বিশেষ আসর। এ আসরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শূন্য।’ আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর পান্থপথের দৃকপাঠ ভবনে প্রদর্শনী, শিল্পী পরিচিতি ও আলোচনার মধ্য দিয়ে এ উৎসব শুরু হয়।
‘শূন্য’ উদ্বোধন করেন পাঠশালা ও ছবি মেলার প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, উৎসব পরিচালক তানজিম ওয়াহাব, নির্বাহী পরিচালক এএসএম রেজাউর রহমান ও কিউরেটর সরকার প্রতীক। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে দৃকপাঠ ভবনে ছিল সীমিত পরিসরের উদ্বোধনী শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রা ও আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আলোকচিত্রী, শিল্পী ও কিউরেটরেরা। সন্ধ্যা সাতটায় ছবি মেলা ‘শূন্য’-এর পডকাস্ট সিরিজের অংশ হিসেবে ছিল আন্তর্জাতিক কিউরেটর ও লেখক নাতাশা জিনওয়ালা এবং ব্রিটিশ-নাইজেরিয়ান আলোকচিত্রী আকিনবোদে আকিনবিয়ির কথপোকথন। যেটি শোনা যাবে উৎসবের ওয়েবসাইটে। এ ছাড়া রাত ৮টা থেকে ছিল দুই ঘণ্টার নিয়মিত রেডিও অনুষ্ঠান ‘বাবা বেতার।’
অন্যবারের তুলনায় ছবিমেলা এবার বেশ ছোট পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে। তবু দৃকপাঠ ভবনে প্রদর্শিত হয়েছে বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম যা একই সঙ্গে উপভোগ করা যাবে অনলাইনেও। শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্য বৈচিত্রপূর্ণ রূপে ব্যবহার করা হয়েছে ভবনের বিভিন্ন তলা, ছাদ, সিঁড়িসহ নানা জায়গা।

গত ১০ বছরে মোট ১০টি ছবিমেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবারই এই অনুষ্ঠানে নানা শিল্পকর্মসহ অংশ নেন বিশ্বের নানা প্রান্তের আলোকচিত্রী, নানা মাধ্যমের শিল্পী, লেখক-চিন্তক, বুদ্ধিজীবী। এবার করোনাকালের নতুন বাস্তবতায় কেবল বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার শিল্পীদের কাজ স্থান পেয়েছে ছবিমেলায়। ৭৫ জন শিল্পীর কাজ নিয়ে মোট ৮টি প্রকল্পে সাজানো হয়েছে এবারের মেলা।

নানা শিল্পকর্মে পূর্ণ ছবিমেলা ‘শূন্য’

মহামারিকালে মেলার আয়োজকেরা নিজেদের কাজকে নতুন করে পর্যালোচনা করতে চেয়েছেন। শুরু করতে চেয়েছেন শূন্য থেকে, ফিরে যেতে চেয়েছেন অতীতে। বুঝতে চেয়েছেন, বর্তমান এবং করোনা মহামারির এই কালকে। বুঝতে চেয়েছেন, সীমাহীন জীবন ও জীবিকা হারানো এই দুঃসময়ে ছবিমেলার প্রাসঙ্গিকতাকে। প্রশ্ন তুলতে চেয়েছেন, এই মহামারির সময় শিল্পের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। আর এবারের ছবিমেলা কেবল আলোকচিত্র নয়, বহু মাধ্যমের শিল্পীদের কাজে হয়েছে বৈচিত্র্যময়। আলোকচিত্রের পাশাপাশি, চিত্রকর্ম, চলচ্চিত্র, স্থাপনাশিল্প, ভাস্কর্য, ভিডিও–সাউন্ড, প্যানেল আলোচনা, সংগীত, বেতার সম্প্রচার, অ্যানিমেশন, অস্থায়ী স্টুডিওসহ নানা মাধ্যমে কাজ করা শিল্পীদের মধ্যে সেতুবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে ছবিমেলা। মহামারিকালে নতুন ভার্চুয়াল বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে এবারের ছবিমেলায় ডিজিটাল উপস্থাপনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

করোনাকালে সদ্যপ্রয়াত স্থপতি বশিরুল হক এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী প্রয়াত সাইদা খানম স্মরণে প্রদর্শনীতে এবার তাঁদের কাজ স্থান পেয়েছে। বশিরুল হকের তৈরি স্থাপত্য নকশার ছবি ও অন্যান্য কাজ নিয়ে গবেষণাধর্মী ‘উইশিং ট্রি’ স্থান পেয়েছে ছবিমেলায়। সাইদা খানমের কাজ নিয়ে প্রদর্শিত হয়েছে ‘দ্য রেবেল উইথ আ স্মাইল।’ বরাবরের মতো এবারও ১৪ জন তরুণ শিল্পীকে ছবিমেলায় দেওয়া হচ্ছে ফেলোশিপ বা বৃত্তি।

নাজমুন নাহার কেয়ার কিউরেশনে ছবিমেলায় রয়েছে ‘ফ্রোজেন সং।’ যেখানে বিভিন্ন প্রজন্মের ভিন্নধর্মী ৫ শিল্পী দৃকপাঠ ভবনের নানা স্থানকে বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের কাজ তুলে ধরেছেন। সেসবের মধ্যে আছে ভাইরাল হওয়া ফেলানীর ছবি, শহিদুল আলমের গ্রেফতারের ছবিসহ নানা ছবি। দিলারা বেগম জলির প্যানডেমিকের সময় করা কাজের স্থাপনাশিল্প, রাজনৈতিক স্কেচসহ আরও কয়েকটি কাজ। পাশাপাশি সুইস শিল্পী-গবেষক মারা জুসের সঙ্গে পাঠশালার কর্মশালার অংশ হিসাবে থাকছে ‘ছাপাখানা আর্কাইভ।’

এ ছাড়া ছবিমেলা ‘শূন্য’তে দৃক ও পাঠশালার বিশেষ আয়োজন রয়েছে ১৪ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আছে আলোকচিত্রসহ অন্যান্য শিল্পবিষয়ক বুক কর্নার, বিভিন্ন ফটোগ্রাফি স্কুলের সঙ্গে পরিচিতি ও সলিডারিটি, ফটো–সাংবাদিকদের কাজের অভিজ্ঞতা, নারী সাংবাদিক ও শিল্পীর করোনাকালে অভিজ্ঞতা ও আড্ডা। থাকছে ছবি ও ক্যামেরার পেছনের বন্ধুদের ছবিমেলা পরিদর্শন, পাঠশালার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিল্পীদের কাজের অভিজ্ঞতার ভাবনা বিনিময়।

দশ দিনের ছবিমেলা চলবে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত

থাকছে পাড়া বা এলাকাভিত্তিক হারিয়ে যাওয়া স্টুডিওর আলোকে আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের ‘পাপ্পু স্টুডিও’ নামে অস্থায়ী স্টুডিও। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে স্টুডিও চালাচ্ছেন আনোয়ার হোসেন। আলোকচিত্রী হিসেবে আনোয়ার হোসেনের অভিজ্ঞতা প্রায় ৬০ বছরের। ছবিমেলায় তিনি সেই অভিজ্ঞতা এবং কাজের ধারা পরিবর্তন নিয়ে কথা বলবেন।

একইসঙ্গে অস্থায়ী স্টুডিওতে ছবি তুলে প্রিন্ট করে দেবেন তাৎক্ষণিকভাবে।
কাল শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনে উদ্‌যাপিত হবে ‘দৃক দিবস।’ এ দিন দৃকের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা, ঐতিহাসিক আর্কাইভাল প্রিন্ট, ক্যালেন্ডার ও অন্যান্য স্মারক দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরা হবে। দশ দিনের ছবিমেলা চলবে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ছবিমেলা ঘুরে আসা যাবে প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা।

ছবিমেলায় থাকছে ৪টি আর্ট কালেকটিভ, ‘ক্রসরোডস’। এতে থাকছে দেশ–বিদেশের ৩২ জন শিল্পীর কাজ। পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণে তৈরি হওয়া এই কাজগুলোর মধ্যে সংহতি, বোঝাপড়া, ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের ছাপ খুঁজে পাবেন দর্শকেরা।

ছবিমেলায় ভিন্নধর্মী উপস্থাপনা ‘বাবা বেতার’, একটি ওয়েব রেডিও ও শব্দ মাহফেজখানা। বাংলাদেশে করোনাকালের প্রথম দিকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় শিল্পী আরফান আহমেদ তৈরি করেন ‘বাবা বেতার’ নামে এই নিরীক্ষামূলক আর্ট রেডিও প্রজেক্ট। মার্চ থেকে টানা ৩৬ দিন ফেসবুক পেজ এবং ক্লাউড রেডিও প্ল্যাটফর্ম থেকে এই ওয়েব বেতারটি ‘বাবা বেতার’ নামে সম্প্রচারিত হয়। বর্তমানে ‘বাবা বেতার’ তার শব্দ মাহফেজখানাকে নতুনভাবে সজ্জিত করেছে ছবিমেলা ‘শূন্য’র জন্য। ছবিমেলা চলাকালীন মেলার নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে টানা ১০ দিন রাত ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এর সম্প্রচার হবে। এই ওয়েব রেডিওতে রয়েছে মহামারি অভিজ্ঞতা, পরিবেশ ভাবনা, বিভিন্ন জনের লেখা গল্প-কবিতা-গান-প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন সাউন্ড এক্সপ্রেশন।