১৯৯০–এর দশকে পৃথিবী মত্ত হলো উপসাগরীয় যুদ্ধে। তারই মধ্যে নিরাপদে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য এক দম্পতি সৌদি আরব থেকে উড়াল দিলেন বাংলাদেশে। মেয়ে জন্মাল। নাম রাখা হলো নাজিবা বাশার। যুদ্ধ শেষ হলো। তারপর তাঁরা পরিবারের নতুন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে আবার উড়াল দিলেন সৌদি আরব। নাজিবার জীবনের প্রথম ১৪ বছর কেটেছে সেখানেই। তারপর ফিরে এসে ভর্তি হলেন ম্যাপললিফ স্কুলে। ও লেভেল, এ লেভেল করলেন। মা শাস্ত্রীয় সংগীত গাইতেন। তাই শুনে ছোটবেলা থেকেই তাঁর নাচের সাধ জেগেছিল। তাই শুক্লা সরকারের অধীনে ধ্রুপদ কলাকেন্দ্র থেকে ভরতনাট্যমের ওপর তালিম নেন। যোগ দেন একটা ইংরেজি পত্রিকায়, সহকারী সম্পাদক হিসেবে। কিন্তু বাংলাটা ঠিক কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারছিলেন না।
অভিনয়ের অ আ ক খ
নাজিবা বাশারের মা–বাবা দুজনেই ছিলেন থিয়েটারকর্মী। ঢাকা থিয়েটার করতেন। তাই গুণী অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল তাঁর মা–বাবার। সেই সূত্রে বদরুল আনাম সৌদের পরিচালনায় ধারাবাহিক এলেবেলেতে কাজ শুরু করেন নাজিবা। তাঁর যে অভিনয়ের ইচ্ছা হয়েছিল, তা নয়। ইচ্ছাটা ছিল মা–বাবার। ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে হয়েছিল। কিন্তু কাজ করে তেমন ভালো লাগেনি নাজিবার। ভাবলেন, আর নয় অভিনয়। কিন্তু মা–বাবা তাঁকে আরেকবার চেষ্টা করতে বলেন। কথা দেন, এবার যদি ভালো না লাগে, তাহলে আর অনুরোধ করবেন না। সেবার একই পরিচালকের পিঞ্জর নামে আরেকটি ধারাবাহিকে কাজ করেন তিনি। সেই নাটকে তাঁর ‘পরী’ চরিত্রটা মনে ধরে যায়। এই চরিত্রই তাঁকে প্রথম অভিনয়ের প্রতি কৌতূহলী করে তোলে। এরপর কাজ করে ফেলেন সাত–আটটি বিজ্ঞাপনচিত্রে।
চলচ্চিত্র যাত্রা
এরপর বদরুল আনাম সৌদের গহীন বালুচর ছবিতে নাজিবা বাশার কাজ করেন নৃত্য পরিচালক হিসেবে। এখানে একঝলকের জন্য ক্যামেরার সামনে দেখাও দিয়েছেন। অভিনয়শিল্পী হিসেবে পাঁচটি ছবিতে কাজ করেছেন—মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত যদি একদিন, রাশান নূর পরিচালিত বেঙ্গলি বিউটি,মিজানুর রহমান পরিচালিত নুরু মিয়া ও তার বিউটি ড্রাইভার, জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত মনের মতো মানুষ পাইলাম না ওতানভীর মোকাম্মেলের রূপসা নদীর বাঁকেতে। শেষ ছবিটি এখনো মুক্তি পায়নি। তানভীর মোকাম্মেলের এই ছবির প্রধান নারী চরিত্রটিই বড় পর্দায় জীবন্ত হবে নাজিবা বাশারের শরীরে, রক্তে, হৃদয়ে। এখানে তাঁকে দেখা যাবে বামপন্থী আন্দোলনের নেতা মানব মুখোপাধ্যায়ের প্রেমিকার চরিত্রে।
ওয়েব সিরিজ ‘মানিহানি’
অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ের অরিজিনাল ওয়েব সিরিজ মানিহানি যিনি দেখেছেন, তিনি এসিপি মারিয়া গোমেজকে মনে রাখতে বাধ্য। এই মারিয়া গোমেজ হয়েই তিনি কাঁটাতার পেরিয়ে পৌঁছেছেন কলকাতায়। জয় করেছেন সেখানকার মানুষের হৃদয়। কলকাতার একটা রেডিওতে তো বলাই হয়েছে, এসিপি মারিয়ার মতো শক্তিশালী নারী চরিত্র খুব কমই আছে। এই ওয়েব সিরিজের অন্যতম পরিচালক কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় একদিন তাঁর অফিসে ডাকলেন নাজিবা বাশারকে। চরিত্রের নাম, পরিচয় দিলেন। শোনার সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ করে দিলেন নাজিবা। কেন? প্রথম আলোর সঙ্গে কথোপকথনে নাজিবা দিলেন সেই উত্তর। ‘ছোটবেলা থেকেই “উইমেন ইন ইউনিফর্ম” ব্যাপারটা আমাকে খুব টানত। আমি তো বড়ই হয়েছি পুলিশ হব বলে। কিন্তু সেসব আর হলো কই? তাই পর্দায় সিআইডি হওয়ার সুযোগ পাওয়ামাত্র লুফে নিয়েছি। কারণ, আমার ভেতরে এসিপি মারিয়া গোমেজের একটা সত্তা আগে থেকেই ছিল, ভালোভাবেই ছিল। তাঁকে শুধু যত্ন নিয়ে জাগিয়ে তুলেছি।’
মানিহানির শুটিংয়ের দিনগুলো
নাজিবা বাশার বাংলা পারেন বা না পারেন, জেরা করার সময় মারিয়া গোমেজকে তো অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেই হয়। নাজিবা অন্য সব দিক থেকে মারিয়ার মতো, শুধু এই গালাগালির অংশটুকু ছাড়া। তো ‘খাঁটি বাংলায়’ গালি দেওয়ার শটের পর পরিচালক কৃষ্ণেন্দু গম্ভীরভাবে বললেন, ‘মনে হচ্ছে নিজের সঙ্গে সংগ্রাম করে অনেক কষ্টে গালাগাল মুখে আনতে হচ্ছে। এভাবে তো হবে না।’ এরপর অনেক চেষ্টার পর নিজের আড়ষ্টতা কাটিয়েছেন নাজিবা। এ তো গেল একটা। আর যখন কারওয়ান বাজারের ভেতর দিয়ে দৌড়ে ব্যাংকের চোরদের ধরতে হয়েছে? নাজিবার ভাষায়, ‘টিভিতে, সিনেমায় দেখে তো সহজই লাগত। কিন্তু প্রতিটা শট শেষ করে কী যে জোরে জোরে হাঁপাতাম। তারপর একটু শান্ত হয়ে দেখতাম, সবারই কমবেশি কেটে ছিলে গেছে।’ তবে একটা আক্ষেপ আছে নাজিবার। এই সিরিজের অন্য সবাই প্রতিটা শটের আগে মোটামুটি জামাকাপড় বদলেছে, মেকআপ নিয়েছে। কিন্তু মারিয়া পুরো সিরিজ শেষ করেছেন তিনটামাত্র টপস আর একটা বা দুটো প্যান্ট দিয়ে। আর ‘প্রায়’ মেকআপ ছাড়া।
যে চরিত্র দিয়ে প্রথাবিরোধী ইতিবাচক বার্তা দেওয়া যায়, সেই চরিত্র টানে নাজিবাকে। বেছে বেছে কাজ করেন তিনি। তা তো করতেই হবে। একই সঙ্গে সহসম্পাদক আর অভিনয়শিল্পী হওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!