ইলা মা ও তাঁর মেয়ে আয়ূষী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার বাউল। ঢাকার বাউল উৎসবে এসেছিলেন তাঁরা। উৎসব শেষে প্রথম আলো অনলাইনের স্টুডিওতে গান করলেন। তারপর সভাকক্ষে খানিকক্ষণ আড্ডার অনুরোধ করলে সেটাও গ্রহণ করলেন। তাঁদের সঙ্গে আড্ডার লোভ কি সামলানো যায়? দুজনই লালনের গান করেন। দুজনেরই পড়াশোনা শারীরিক শিক্ষা ও যোগব্যায়াম বিষয়ে। পড়েছেনও একই কলেজে। মা ছিলেন মেয়ের এক ক্লাস ওপরে। পড়াশোনায় বিশাল বিরতি ছিল যে! বিয়ের আগে থেকেই রেডিওতে গান করতেন ইলা মা। বৈষ্ণব গোত্রের মানুষ তাঁরা। বিয়ের পর প্রায় ১৭ বছর গান করা হয়নি ইলা মা’র, কেবল নিজের মতো করে অনুশীলন করে গেছেন। রীতিমতো সংগ্রাম করে পরে শ্বশুরবাড়ির মানুষদের রাজি করিয়েছেন, গান তাঁকে করতেই হবে। এখন ব্যবসায়ী স্বামী, মানে আয়ূষীের গানপাগল বাবা দারুণ সহযোগিতা করেন মা–মেয়েকে।
আগেও ঢাকায় এসেছেন দুজন। বাংলা যখন ভাগ হয়নি তখন কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও নদীয়া নিয়ে ছিল বৃহত্তর নদীয়া। তার প্রাণকেন্দ্র কৃষ্ণনগরে ছিল লালন সাঁইজির চলাফেরা। সেখানেই তাঁদের বাড়ি। এখনো সেখানে রয়েছেন লালনের বহু অনুসারী ও অনুরাগী। দেশভাগের পর সেখানে লালনচর্চা কিছুটা কমে গেছে, তবে মুছে যায়নি, জানালেন ইলা মা। বললেন, ‘তাঁরই উত্তরসূরি আমরা। বহু মানুষ লালনকে নিজের ভেতরে লালন করে রেখেছেন। তাঁকে নিয়ে আমাদের ওদিকে অনেক উৎসব, মেলা, সেমিনার ও সাধুসঙ্গ হয়। সাঁইজির মাজারের মাটি নিয়ে গিয়ে সেখানে একটা উৎসব শুরু হয়েছিল বেশ আগে। সেটা এখনো আয়োজন করা হয়।’
আয়ূষী কীভাবে মায়ের সঙ্গে যুক্ত হলেন? শৈশব থেকেই নাকি যোগ ও লালনগীতি আকৃষ্ট করে তাঁকে। আয়ূষী বললেন, লালনগীতি ও যোগ ব্যায়ামের মধ্যে যোগসূত্র আছে। সাঁইজির গানের ভেতরে দেহতত্ত্ব আছে। তাঁর পদে ঈশ্বরপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে, শ্বাস–প্রশ্বাস নিয়ে অনেক কথা আছে। যোগেও সেসব আছে। ধ্যানে যেমন আত্মস্থ হওয়া যায়, সাঁইজির গান গাইতে গাইতেও তেমনটা হয়।
জানতে ইচ্ছে করে, মূলধারার জীবন যাপন করে লালনচর্চা করা যায়? তার ওপর এই বিচ্ছিন্নতাবাদের সময়ে? ইলা মা বললেন, ‘অনেকে ভাবেন যে সেটা ভীষণ কঠিন। কিন্তু সাঁইজির একটা গান ধরেই যদি ভাবনাকে এগিয়ে নেওয়া যায়, তাহলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। তিনি মানুষ ভজনের কথা বলেছেন, সেটা প্রেমের কথা। প্রেম মানে এক হওয়া। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদের ঠাঁই নেই। মানুষ ভিন্ন হতে পারে ভাবনায়, বর্ণে বা কর্মে। কিন্তু প্রেমে এসে এক হয়ে যায়। সবার মধ্যে নিজেকে আত্মনিবেদন করে। এটাই সাঁইজির শিক্ষা। অহংবোধ বিসর্জন দিয়ে যদি মানুষের কাছে যাওয়া যায়, তাহলেই তো শ্রেষ্ঠ ধনকে আশ্রয় করা সম্ভব। গান গেয়ে সেটা যদি দশজনকে বোঝাতে পারি, তবেই আমরা সার্থক।’
জানতে চাই ঢাকায় এলে কোথায় যেতে ভালো লাগে? ইলা মা জানান, হাতিরঝিল তাঁর প্রিয় জায়গা। এটা শহরের ভারসাম্য ধরে রেখেছে। ‘আয়ুর্বেদে বলে, ঘরের ভেতর একটা পাত্রে পানির মধ্যে কিছু ফুল ভাসলে ঘরের পরিবেশে একটা ভারসাম্য আসে। ঢাকা শহরের সেই ভারসাম্যটা তৈরি করেছে হাতিরঝিল। সেটা কেবল শহরের নয়, মানুষের ভাবনায়ও ভারসাম্য তৈরি করে’, বলেন ইলা মা। বাকি কথায় বুঝে নিই, রমনা পার্ক, শিল্পকলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও তাঁর পছন্দের স্থান।
আয়ূষীরা অনে ক মানুষকে যোগবিদ্যা শেখাচ্ছেন। অনেক বছর ধরে পারিবারিকভাবে চালাচ্ছেন একটা ইয়োগা ইনস্টিটিউট। সেটার পরিসর আরও বাড়াতে চান। আয়ূষী জানালেন নিজের স্বপ্নের কথা, ‘একটা আশ্রম করতে চাই। লালনের গান ও যোগবিদ্যাকে আশ্রয় করে যদি মানুষকে কিছুটা সেবা দেওয়া যায়, সেটাও আমার জন্য অনেক বড় কাজ হবে।’ তাঁদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশেও সে রকম একটা জায়গা করা।
কে বেশি ভালো গায়, মা নাকি মেয়ে? এমন প্রশ্নে দুজনই দুজনের দিকে আঙুল তোলেন। মা বলেন, ‘ও গানচোর। আমি কোনো একটা গান তুলতে শুরু করলে সে চুপচাপ শোনে। পরে দেখি নিজেই আমার সঙ্গে গাইছে। কিছু কিছু জায়গায় এত আবেগ দিয়ে গায়, সেটা ওর বয়সে আমি পারতাম না।’
সবশেষে বলি, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান? মা বলেন, ‘না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের কাছে যাঁরা যোগ শিখতে আসেন, তাঁদের অনেকের কাছে প্রথম আলোর কথা শুনেছি। আজ সেখানে কিছুটা সময় কাটাতে পেরে ভালো লাগল।’