>
দর্শকনন্দিত দুটি নাটক মেরাজ ফকিরের মা ও নিত্যপুরাণ। মেরাজ ফকিরের মা নাটকটি পেরোল ২০০তম রজনী এবং নিত্যপুরাণ পার করল শততম রজনী। নাটক দুটির দুই মাইলফলক পেরোনোর গল্প নিয়ে লিখেছেন শরীফ নাসরুল্লাহ।
মেরাজ ফকিরের মা
২০০তম রজনীতে উজ্জ্বল
আবদুল্লাহ আল–মামুনের অমর সৃষ্টি মেরাজ ফকিরের মা। এই নাট্যকার ও নির্দেশকের ৭৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত হলো অনুষ্ঠান। জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন আলোকিত হলো তাঁর রচিত ও নির্দেশিত নাটকের ২০০তম প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। জন্মের ৩৯ বছর পর আকস্মিকভাবে জানা যায়, গর্ভধারিণী মায়ের ধর্ম আর ছেলের ধর্ম এক নয়। ধর্মপরিচয়ে যে ফারাক রচিত হয়, তা কি মা-ছেলের সম্পর্ককে ফারাক করে দিতে পারে? ধর্মের ভিন্নতার কারণে ছেলে কি অস্বীকার করতে পারে তার মাকে? মানবিক সম্পর্ক আর বাহ্যিক আচারসর্বস্ব সম্পর্ক—দুইয়ের মধ্যে কোনটির সঙ্গে রয়েছে নাড়িছেঁড়া টান? এমনই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং মানবের স্বরূপ প্রকাশের চেষ্টার গল্প নিয়ে নাটক মেরাজ ফকিরের মা।
লেখা হয়েছিল অন্য দলের জন্য
১৯৯৫ সালে মঞ্চে আসে নাটকটি। নাটকের দল থিয়েটারের নাট্যকার ও নির্দেশক আবদুল্লাহ আল–মামুন নাটকটি লিখেছিলেন বাইরের একটি দলের জন্য। সেই স্মৃতিচারণা করলেন নাটকের অন্যতম কুশীলব ও শক্তিশালী অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘এই নাটকের পেছনে একটা ঘটনা আছে। তিনি (আবদুল্লাহ আল-মামুন) আমাদের দলের নাট্যকার, তবে অনেকের জন্যই লিখতেন। একদিন তিনি খুব বিষণ্ন। সবাই বলছে, “কী হয়েছে, স্যার?” তিনি কিছু বলছেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এত বিষণ্ন হয়ে আছেন কেন, কী হয়েছে?” তিনি বললেন, “একটা সংগঠনের জন্য এই নাটকটি লিখেছি। নাটকটির সবই তাদের পছন্দ, একটি জায়গায় সমস্যা। এর প্রধান চরিত্র মেরাজ ফকিরের মা হিন্দু। তাকে মুসলমান বানিয়ে দিতে হবে।” এতেই তাঁর মন খুব খারাপ হয়েছে। কারণ সাম্প্রদায়িকতা নিয়েই তিনি নাটকটি লিখেছিলেন। আমি বললাম, “আমরা করি তাহলে?” আমি পাণ্ডুলিপিটা হাতে নিলাম। তিনি বললেন, “আপনি পড়ে দেখেন, আপনার যদি একটা সংলাপও খারাপ লাগে, বলবেন।” পাণ্ডুলিপি খোলামাত্রই মেসেজ দেওয়ার মতো একটা সংলাপ দেখলাম। নাটকের মূল বক্তব্য—সবার ওপরে মা। সেই সংলাপে এটি প্রকাশ পেয়েছে। আমার ভীষণ ভালো লাগল।’
এরপর দলের অন্যতম প্রাণপুরুষ রামেন্দু মজুমদার দেখলেন অসাধারণ পাণ্ডুলিপি এটি। শুরু হলো মহড়া। মহড়াকক্ষ থেকে মঞ্চে। ২০০টি রজনী পেরিয়ে গেল।
টানা ২০০টি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ
নাটকটির ২০০তম প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য একটি দিক ছিল, তিন অভিনেতার টানা ২০০টি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার ও মারুফ কবির—বাদ দেননি একটি রাতও। তাঁরা পেলেন সম্মাননা।
ফেরদৌসী মজুমদার জানালেন, নাটকটাকেই তিনি বেশি ভালোবাসেন। তাই তো একটি প্রদর্শনীও এমন যায়নি, যেটায় তিনি অংশগ্রহণ করেননি। নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার জানালেন, ঘটনাচক্রে আসলে সব কটি প্রদর্শনীতেই অভিনয়টা হয়ে গেছে। এই তিনজন ছাড়া ত্রপা মজুমদারও ১৯৯টি শো করেছেন। তিনি মা হওয়ার সময় একটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
আয়োজনটি চলেছে ১২ ও ১৩ জুলাই। ছিল একটি স্মারক বক্তৃতাও। ‘বর্তমান প্রেক্ষিতে নাট্য প্রযোজনা ও অভিনয়’ নিয়ে বক্তৃতা দেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ।
নিত্যপুরাণ
বৃদ্ধাঙ্গুলি বিসর্জনের শতরাত্রি
গত শুক্রবার ছিল অবিরাম বৃষ্টি। তবু দমাতে পারেনি নিত্যপুরাণ–এর দর্শকদের। শততম রজনীতে হাজির তাঁরা। মহাভারতের ব্রাত্য চরিত্র একলব্য। সেই একলব্যই নায়ক হয়ে ওঠেন এই নাটকে। মহাভারতের অন্য পাঠ দাঁড়িয়ে যায় মাসুম রেজার বয়ানে। নাটকটির রচয়িতা ও নির্দেশক তিনি। এটি তাঁর কোনো নাটকের ১০০তম প্রদর্শনীও। স্মৃতিচারণায় মাসুম রেজা চলে গেলেন তারও আগে, যখন বিন্দু বিন্দু করে জমা হচ্ছে নিত্যপুরাণ–এর গল্প।
মাসুম রেজা বলেন, ‘আমি তখন মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারত, ওডিসি, ইলিয়াড পড়ছি। আমরা জানি যে মহাভারতের নায়ক বলতে অর্জুনকে বোঝায়, কর্ণকে বোঝায়। যা লেখালিখি তা–ও তাঁদের ঘিরেই। কখনো আমাদের দেশে একলব্যকে নিয়ে কিছু হয়নি। আমি পড়তে গিয়ে দেখলাম, একলব্যই তো ব্রাত্যজনের নায়ক, প্রতিনিধি। তাঁকে শিখতে দেওয়া হয়নি। দ্রোণাচার্য তাঁকে অস্বীকার করেন। তারপরে তিনি জঙ্গলে দ্রোণের মূর্তি তৈরি করেন, তাঁকে গুরু মেনে অস্ত্রবিদ্যা শেখেন। এরপর তিনি বীরে পরিণত হন। তখন দ্রোণই ষড়যন্ত্র করে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে। আমার কাছে মনে হয়েছে পতিত এই বীরকেই নাটকে নিয়ে আসতে হবে।’
নিত্যপুরাণ–এর যাত্রা শুরু হয় ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি। ২০১৯ সালের ১২ জুলাই ছিল এর শততম রজনী। এর মধ্যে পেরিয়ে যাওয়া প্রতিটি রাতেই মঞ্চে দ্রোণের কাছে বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিতে হয়েছে একলব্যকে। তাইতো, শততম রজনীর নাম
রাখা হলো, ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি বিসর্জনের শতরাত্রি’।
একলব্য ও দিলীপ চক্রবর্তী
একলব্য চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন প্রয়াত দিলীপ চক্রবর্তী। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে একলব্য আর দিলীপ যেন একই নাম হয়ে দাঁড়ায়। ২০০০ সাল। মহাভারত থেকে নিয়ে নিজের গড়া চরিত্র একলব্যের জন্য দিলীপ চক্রবর্তীকেই পছন্দ করলেন মাসুম রেজা। স্মৃতিচারণা করলেন এভাবে, ‘আমার সঙ্গে সাবলাইম মিডিয়াতে কাজ করত দিলীপ চক্রবর্তী। অনেক ভেবে আমার মনে হলো, দিলীপই হবে আমার একলব্য। আমার সঙ্গে করে গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে আসতাম। পরামর্শ দিতাম। একটা দীর্ঘ প্রস্তুতির পরে দিলীপ মঞ্চে এল।’ প্রথম প্রদর্শনীতেই বাজিমাত। তারপরে মঞ্চনাটকে নিত্যপুরাণ যুক্ত হলো একটি সফল প্রযোজনা হিসেবে। এরপর দিলীপের প্রয়াণ ও কিছু অভ্যন্তরীণ কারণে ২০০৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নাটকটি বন্ধ ছিল। আবার ২০১৭ সালে দিলীপের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যই শুরু হয় নাটকটির প্রদর্শনী। নতুন একলব্য হয়ে এলেন মামুন চৌধুরী।
মহাভারতের ভিন্ন পাঠ
মহাভারতে দ্রৌপদী অন্যতম চরিত্র। মাসুম রেজার নিত্যপুরাণ–এও দ্রৌপদী আছেন। তবে মহাভারতে একলব্যের সঙ্গে দ্রৌপদীর দেখা হয় না, কিন্তু এই নাটকে একলব্যের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। দ্রৌপদীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিরিন খান, নাজনিন চুমকী, বন্যা মির্জা ও সুষমা সরকার। ৭৫তম মঞ্চায়নে তাঁদের সবাই অংশগ্রহণ করেছিলেন ‘বহুবর্ণে এক দ্রৌপদী’ নামের প্রদর্শনীতে। নাটকটির আখ্যান মহাভারত থেকে নেওয়া হলেও মাসুম রেজার মৌলিক কাহিনিতেই এগিয়ে যায় গল্প। মাসুম রেজা বলেন, ‘মহাভারত থেকে শুধু আটটি চরিত্র বাইরে নিয়ে এসে, মহাভারতের অন্য আখ্যান কিংবা মহাভারতের ভিন্ন পাঠ আমি রচনা করেছি।’