বিশ্বময় শান্তিকামী মানুষের দীর্ঘস্বরের উচ্চারণ ‘সন্ত্রাস থেকে মুক্তি চাই’। বিশ্বময় এমন উচ্চারণের পর্দা ভাষ্য ঢাকাঅ্যাটাক। ঢাকাঅ্যাটাকচলচ্চৈত্রিক কলাকৌশলের ফসল। ঢাকাঅ্যাটাকবাংলাদেশের সিনেমার খরা এবং জরাক্রান্ত প্রান্তরে বিনোদন সাপ্লিমেন্ট। ধন্যবাদ বাংলাদেশ পুলিশ পরিবারকল্যাণ সমিতি, পরিচালক দীপংকর দীপনসহ চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি।
ঢাকাঅ্যাটাক নিয়ে কিছু লেখার আদেশপ্রাপ্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত হয়ে পড়ি। বিষয়টি ফিল্মপড়ুয়া আমার ছাত্রদের সঙ্গে শেয়ার করি। অনেকেই বলল, লিখলে অনেক কিছু লিখতে হবে। কিন্তু লেখার দরকার নেই। কারণ, আমার লেখার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সমালোচনা সংস্কৃতি আজও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। চলচ্চিত্র সমালোচক আলমগীর কবির সব সময় তাড়িত জীবন কাটিয়ে গেছেন। আবার কিছু নির্মাতার বিশ্বাস, সমালোচনায় দু-একটি নেতিবাচক মন্তব্য লিখলেই দর্শক হলে আসা বন্ধ করে দেয়। প্রযোজকের নাকি কোটি টাকা লোকসান হয়ে যায়! সত্যপাত্রে হস্ত স্পর্শ করে কোন পরিচালক বলতে পারবেন কথাটি সত্য! কলমের শক্তি আছে ঠিকই কিন্তু দুই কলম লিখে দর্শকের পকেটের কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া কিংবা দর্শককে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বিরল।
সিনেমা চলে দমে। দম না থাকলেই ঠুশ! ঢাকাঅ্যাটাকদমের সিনেমা। গল্পটির বৃহৎ অংশভাগে আছে পুলিশি অ্যাকশন। তিনটি অনুঘটনায় এসেছে পুলিশ কর্মকর্তা আশফাকের (এ বি এম সুমন) পরিবারের গর্ভবতী স্ত্রীর (নওশাবা) অসহায়ত্ব, একাকিত্বের যন্ত্রণা। পরিবারহীন আবিদ (আরিফিন শুভ) এবং সাংবাদিক-কন্যা চৈতির (মাহিয়া মাহি) প্রেমানুরাগ। অন্যদিকে, কোমলমতি শিশু জিসানের মনোবৈকল্যসমেত সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার ঘটনা। ঢাকাঅ্যাটাক-এর চিত্রনাট্যের ‘টোনাল স্ট্রাকচারে’ এই উপাখ্যানগুলো সম্পূরকভাবে সংযুক্ত।
ঢাকাঅ্যাটাকচলচ্চিত্রে সাংবাদিক চরিত্রটি (মাহি) শুধুই হয়তো নায়িকা ধারণার বিকাশ। আবার, একজন উচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত পেশাদার শিল্পী কেন গল্পের পরিবেশ ও চরিত্র অনুধাবনে ব্যর্থ হলেন, সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মাহিয়া মাহির কাছে থাকল। এই চলচ্চিত্রে হাসান ইমাম, আলমগীর ও আফজাল হোসেন রূপায়িত চরিত্রসমূহ পোস্টার চরিত্রস্বরূপ। কেননা, এই চরিত্রগুলোর বিকাশ কিংবা কার্যক্রম কখনোই দর্শকের প্রত্যাশা ও আখ্যানের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়নি। তবে চলচ্চিত্রের মধ্যে এ বি এম সুমন, শতাব্দী ওয়াদুদ, এহসানুর রহমান, আরিফিন শুভর অভিনয় চরিত্র উপযোগী। কিন্তু, প্রাপ্তবয়স্ক জিসান চরিত্র রূপায়ণকারী তাসকিনের অভিনয়কে আলাদাভাবেই চিহ্নিত করা যায়।
সময় ও স্থানকে সংকোচন করতে সম্পাদনায় অ্যাকশন-থ্রিলার ছবির কাটিং-রীতির সফল প্রয়োগে ঢাকাঅ্যাটাক হয়েছে গতিশীল। ক্যামেরায় নানা মাত্রিক কম্পোজিশনসহ সাবজেকটিভ শট ব্যবহারে দর্শকদের দুর্ধর্ষ অভিযানের সঙ্গে একাত্ম করা সম্ভব হয়েছে। লক্ষণীয় যে, ঢাকাঅ্যাটাকচলচ্চিত্রে আরোপিত আবহ সংগীতের প্রয়োগের কারণে পার্বত্য বনভূমির নিঃশব্দ রাতের পারিপার্শ্বিক শব্দ কত ভয়ংকর ও ভীতিকর, তা দর্শক উপলব্ধি করতে পারে না।
এ ছাড়া সিনেমার দৃশ্য আয়োজন, সাউন্ড ইফেক্ট, স্পেশাল ইফেক্ট এবং পুলিশ অভিনেতাদের শারীরিক ভাষায় স্মার্টনেস লক্ষণীয়। দেশ-বিদেশের টেকনিক্যাল কলাকুশলীদের কাছ থেকে পরিচালক শ্রেষ্ঠ কাজ আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছেন।
সেই সঙ্গে এই চলচ্চিত্রের নির্মাণপ্রক্রিয়ায় পুলিশ বাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতা, দৃশ্য ও দৃশ্যের উপাদানগুলো সত্যরূপে উপস্থাপন করে দর্শককে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। তাই বলতে হয়, চলচ্চিত্রের মতো বৃহৎ শিল্পকে সুষ্ঠুভাবে নির্মাণের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা যে অত্যাবশ্যক, ওরা১১জন-এর পরে ঢাকাঅ্যাটাক-এর মধ্য দিয়ে তা আবরও প্রমাণিত হলো। উল্লেখ্য, টেলিভিশন নাট্যনির্মাতাদের নির্মিত অধিকাংশ চলচ্চিত্র সাধারণ্যে নাটক দোষে দুষ্ট হয়। দীপংকর দীপনের ঢাকাঅ্যাটাকএই অপবাদমুক্ত।
লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক ও সমালোচক