৩৮ বছর ধরে সক্রিয়ভাবে নিয়মিত মঞ্চ নাট্যচর্চা করে যাওয়া যেকোনো দলের জন্য গর্বের। সেই গর্বিত লোক নাট্যদল ৬ জুলাই উদযাপন করল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এবারের আয়োজনে নাটক প্রদর্শনীর পাশাপাশি তারা স্বর্ণপদক দিল তিন গুণীকে।
১৯৮১ সালের ৬ জুলাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে লোক নাট্যদলের জন্ম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই দিনের কথা স্মরণ করলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। তাঁর মতে, এ দলের প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা ছিল। গত শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে ‘লোক নাট্যদল স্বর্ণপদক ২০১৯’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এই স্মৃতিচারণা করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী।
এর আগের দিন ৫ জুলাই সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে ‘সোনাই মাধব পালা’ দিয়ে শুরু হয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন। শুরুর দিন থেকে উৎসব সফলতা পায়। এদিন মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে পদাবলি যাত্রা ‘সোনাই মাধব’ও দর্শকদের মুগ্ধ করে। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই নাট্য প্রযোজনার কোনো মুহূর্তই ফাঁকা মনে হয়নি। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কুশীলব, নাট্য কুশীলব, গায়ক-গায়িকা সবাই পালার ঢঙে চতুষ্কোণ মঞ্চের চারধারে বসে ছিলেন। মুখ্য চরিত্র সোনাই আর মাধবের ভূমিকায় রূপসা ও লিটন অভিনয় করেছেন নিজেদের যোগ্যতানুযায়ী। সব মিলিয়ে দর্শকদের নির্মল আনন্দ দেয় ‘সোনাই মাধব’।
পরদিন শনিবার মূল আয়োজন ছিল স্বর্ণপদক প্রদান। এখানেই প্রধান অতিথি ছিলেন প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন লেখক-সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এতে বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তাৎপর্যময় ভূমিকা পালনের জন্য বরেণ্য নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা প্রয়াত কল্যাণ মিত্র, অধ্যাপক আবদুস সেলিম এবং তারিক আনাম খানকে ‘লোক নাট্যদল সম্মাননা ২০১৯’ প্রদান করা হয়। কৃষ্টি হেফাজের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লোক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা ও অধিকর্তা লিয়াকত আলী। সম্মাননা প্রদান শেষে সন্ধ্যা সাতটায় প্রদর্শিত হয় দলের নতুন প্রযোজনা বুদ্ধদেব বসুর গল্প অবলম্বনে লিয়াকত আলী নির্দেশিত ‘আমরা তিনজন’। এটি ছিল প্রথম দিনের তুলনায় সম্পূর্ণ বিপরীত নাটক। ধীর, স্থির সংলাপনির্ভর। ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের নাটকে আক্ষরিক অর্থে সারাক্ষণই পিনপতন নীরবতা ছিল মিলনায়তনে। দর্শক বেশ মনোযোগ দিয়েই নাটকটি দেখেছেন। যেখানে সংলাপগুলো শোনা গেছে কবিতার মতো আর গল্পটা নস্টালজিয়ায় ভরা। এ বছরের ৩০ এপ্রিল জাতীয় নাট্যশালায় নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়।
এত বছরেও কীভাবে সমানভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখল দলটি, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এমন প্রশ্নের জবাবে লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই নিয়মিত নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন নতুন নাট্য বিষয় ও আঙ্গিকের সঙ্গে দর্শকদের সম্পৃক্ত করতে চেয়েছি। লোক নাট্যদল এ পর্যন্ত ৩০টি নাটক প্রযোজনা করেছে। পাশাপাশি নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ নাট্যকর্মী তৈরি করা, সৃষ্টিশীল ও নিষ্ঠাবান নাট্যকর্মীদের সম্মানিত করা, নাট্যচর্চার ইতিহাস সংরক্ষণ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নাটকের সঙ্গে যুক্ত করা, বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোর ও যুবকদের জন্য নাট্যান্দোলন পরিচালনা, নতুন দর্শক সৃষ্টিসহ নানাবিধ সৃজনশীল কার্যক্রম লোক নাট্যদল করেছে নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে। লোক নাট্যদল কর্মীদের শেখায় প্রকৃত নাট্যকর্মী হওয়ার তত্ত্বকথা।’
দলের উদ্যোগে ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর ও যুবদের জাতীয় নাট্য সংঘ ‘পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (পিটিএ)’। গত ২৯ বছরে পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২৮০টি সংগঠন। পিটিএর উদ্যোগে নিয়মিতভাবে শিশুদের নাট্য পাঠশালা, কর্মশালা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর নাট্যোৎসব, যুব নাট্যোৎসব, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিশু-কিশোর নাট্যোৎসবের আয়োজন করা হয়। লোক নাট্যদলের অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলো হলো—পিপল্স লিটল থিয়েটার , পিপল্স থিয়েটার ইন্সটিটিউট, পিপল্স ফিল্ম সোসাইটি, নাট্য তথ্য ব্যাংক। এ ছাড়া পিপলস রেপার্টরি থিয়েটার নামক পেশাদার নাট্য সংগঠনটির ৭টি ‘শিশুদের জন্য বড়দের নাটক’ প্রযোজনা ও মঞ্চায়ন করছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে নাট্য প্রদর্শনীর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও লোক নাট্যদলের রয়েছে দৃপ্ত পদচারণা। এ পর্যন্ত লোক নাট্যদল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মোনাকো, জাপান, জার্মানি, কিউবা, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও ভারতে ৩০টি আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে অংশগ্রহণ করে দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় দলের দর্শকপ্রিয় প্রযোজনা, বাংলাদেশের সর্বাধিক মঞ্চায়িত নাটক ‘কঞ্জুস’ চারটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছে।
লিয়াকত আলী লাকী জানান, পথ চলতে চলতে যাঁরা নাট্যজগৎকে প্রাণ দান করেছেন, লোক নাট্যদল তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৯১ সাল থেকে লোক নাট্যদল প্রবর্তন করেছে ‘লোক নাট্যদল স্বর্ণপদক’। ধারাবাহিকভাবে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর নিয়মিত এই পদক প্রদান করা হয়। মাঝে বেশ কিছু বছর বন্ধ ছিল। এবার তিন গুণীকে সম্মাননা প্রদানের মধ্য দিয়ে আবার চালু হয়েছে কর্মসূচিটি।’