গানের গল্প

তুমি আমার প্রথম সকাল

একটি গান যখন ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে যায়, তখন সেই গানটির পেছনের গল্পটা জানার আগ্রহ তৈরি হয় শ্রোতার কাছে। তেমনি একটি গান ‘তুমি আমার প্রথম সকাল। একাকী বিকেল। ক্লান্ত দুপুরবেলা। তুমি আমার সারা দিনমান। তুমি আমার সারা বেলা।’ এই গানের পেছনে রয়েছেন চারজন মানুষ। এই গানের পেছনের গল্প নিয়ে এই প্রতিবেদন।
তপন চৌধুরী, লতিফুল ইসলাম (পেছনে), শাকিলা ও আশিকুজ্জামান। ছবি: খালেদ সরকার
তপন চৌধুরী, লতিফুল ইসলাম (পেছনে), শাকিলা ও আশিকুজ্জামান। ছবি: খালেদ সরকার

‘তুমি আমার প্রথম সকাল।’ এই গানের পেছনে রয়েছেন চারজন মানুষ। গেয়েছেন তপন চৌধুরী আর শাকিলা। লিখেছেন লতিফুল ইসলাম, সুর করেছেন আশিকুজ্জামান। এক সকালে হঠাৎ এই চারজনকে পাওয়া গেল একসঙ্গে। গানটির পেছনের গল্প প্রথমেই শুনি গীতিকবি লতিফুল ইসলামের কাছে।
‘আসলে গানটি নিয়ে আমার বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছিল না। মনে আছে, একদিন টুলু ভাই তাঁর একজন সহকারীকে আমার বাসায় পাঠান। নাম শামীম। আমি তখনো অতটা গুছিয়ে লেখালেখি করি না। মাথায় কোনো গানের ভাবনা এলে সামনে কাগজের টুকরো পেলে সেখানেই লিখে রাখি। শামীম এসে যখন গান চাইল, তখন তাকে এ রকম বেশ কটি গানের কাগজ বের করে দিয়ে বললাম বেছে নিয়ে যেতে। ও কোন গানটা বেছে নিয়ে গিয়েছিল, জানি না। এর বেশ কিছুদিন পর একদিন রাতে বিটিভিতে অনুষ্ঠান দেখতে বসেছি। ওই সময় “গীতি বিচিত্রা” নামে বিটিভির একটা গানের অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় ছিল। ওই দিন আমার লেখা জেমসের “জেল থেকে বলছি” গানটি ওই অনুষ্ঠানে প্রচার হওয়ার কথা। তখন ‘‘গীতি বিচিত্রা’’ অনুষ্ঠানে একটি গান প্রচারের আগে গীতিকার ও সুরকারের ছবি দেখানো হতো। হঠাৎ দেখি আমার ছবি। আমি তো অবাক! তারপর দেখলাম তপন চৌধুরী আর শাকিলাকে “তুমি আমার প্রথম সকাল” গানটি গাইতে। সেই প্রথম গানটি আমার শোনা। তবে গানটি কবে রেকর্ড হলো, কোন অ্যালবামে গেল, কিছুই জানিনি। যা হোক, সত্যি বলতে কি, গানটি আসলে একটা কবিতা ছিল। তখন আমি কবিতাই বেশি লিখতাম। পাশাপাশি গান লেখার চেষ্টা। টুলু ভাই কবিতাটিকে ঠিকঠাক করে গানই করে ফেললেন এবং এমন গান হলো যে, আমার লেখা কোনো গান যদি বেঁচে থাকে, তবে এই গানটি হবে সেই গান। আমি এর সমস্ত কৃতিত্ব দেব টুলু ভাইকে। পাশাপাশি গুণী দুই শিল্পীকে। অসাধারণ গেয়েছেন তাঁরা।’
এবার আশিকুজ্জামান টুলুর পালা।
‘১৯৯২ সালের কথা। আমি তখন তুষার নামের একজন শিল্পীর অ্যালবাম করছি। ও একদিন শিবলীকে নিয়ে আমার বাসায় এল। বলল, ছেলেটি ভালো গান লিখে। এরপর তুষারের অ্যালবামের সব কটি গানই শিবলী লিখল। ওর লেখা আমার খুব ভালো লাগল। তখন আমি শুধু তোমার জন্য একটি দ্বৈত গানের অ্যালবামের কাজ করছিলাম। ভালো কথার প্রয়োজন পড়ল। মনে হলো, শিবলীর কাছ থেকে একটা গান নেই। ওকে ফোন দেই। বলি, শামীমকে পাঠাচ্ছি। একটা ভালো গান দিয়ে দিয়ো। শামীম ওর বাড়ি গিয়ে “তুমি আমার প্রথম সকাল” গানটি নিয়ে এল। কথাটা দেখেই ভীষণ ভালো লেগে যায়। সুরটা তখন এমনিতেই এসে গেল। এরপর কম্পোজিশন করার পর আরও ভালো লাগল। ওই সময় তপন-শাকিলা জুটি বেশ জনপ্রিয়। কেন যেন মনে হলো, এই জুটি গানটি ভালো গাইবেন। গানটি এত ভালো হলো যে, শুধু তোমার জন্য অ্যালবামের প্রথম গান হয়ে গেল। এরপর এই গানটিই হয়ে যায় এই জুটির সিগনেচার গান।’
স্মৃতিচারণায় এবার তপন চৌধুরী।
‘টুলুকে আমি চিনি ওর ব্যান্ড চাইম থেকে। চাইম থেকে বেরিয়ে আর্ক নামের একটি ব্যান্ড করে টুলু। মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে স্টেজ শোতে দেখা হয়। যা হোক, একদিন ও আমাকে তার সুর করা একটি গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। এটাও বলে, গানটি দ্বৈত গানের একটি মিশ্র অ্যালবামে যাবে। জানতে চাই, দ্বৈত শিল্পী কে? শাকিলা আপার কথা বলে টুলু। এরপর একদিন ট্র্যাকসহ মিনি ওয়াকম্যানে গানটি তুলে নেই। ঠিক এক দিন পরই রেকর্ডিং। পুরানা পল্টনে অরবিট স্টুডিওতে গানটির রেকর্ডিং হয়। মনে আছে, স্টুডিওতে গিয়ে শুনি, শাকিলা আপা আগেই ভয়েস দিয়ে গেছেন। আমি ভয়েস দেওয়ার পর গানটি শুনতে শুনতে মনে হলো, একটু তবলার পারকেশন থাকলে ভালো হতো। টুলুকে বললাম। টুলু তখনই বশিরকে ডেকে নিয়ে এল। বশির এই গানের তবলার সংগত করে। ১৯৯৩ সালে বইমেলায় শুধু তোমার জন্য অ্যালবামটি বের হয়েছিল। এরপর গানটি বিটিভিতে প্রচারের পর এত জনপ্রিয় হয়ে যায় যে, কোনো স্টেজে যখন আমরা দুজন একসঙ্গে গাই, তখন আমাদের সঙ্গে সব দর্শকই গানটি গাইতে শুরু করে। এটি আমার গাওয়া ১০টি সেরা গানের একটি বলে মনে করি।’
চারজনের গানের গল্পের এই আড্ডা বসেছিল শিল্পী শাকিলার বাসায়। তাই সবশেষে স্মৃতিচারণায় অংশ নেন তিনি।
‘তপনদা আর আমি তখন জুটি হয়ে অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছি। আমাদের দুজনের গাওয়া ঢাকা ৮৬ ছবির “পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়” গানটিও তখন বেশ হিট। একদিন টুলু ফোন করে বলে তার সুর করা একটা গান গাইতে। রাজি হই। পুরানা পল্টনের অরবিট স্টুডিওতে কবে ভয়েস দিতে পারব জানতে চায়। আমিও ওকে সময় জানিয়ে দিই। স্টুডিওতে গিয়ে গানটির ট্র্যাক শুনে খুব ভালো লাগে। এরপর আমি প্রথমে ভয়েস দিয়ে চলে যাই। কিন্তু বাসায় গিয়ে মনে হয়, গানটি আরও ভালো গাইতে পারতাম। টুলুকে তখন ফোন দিই। শুনি তপনদা তখন ভয়েস দিচ্ছে। আমিও যাই। তপনদার ভয়েস শেষে গানটি শুনে মনে হয়, আমার গাওয়াটা আসলেই ভালো হয়নি। তাই দ্বিতীয়বার ভয়েস দিই। এরপর বিটিভিতে আমরা একবারই গানটি গাই “গীতি বিচিত্রা” অনুষ্ঠানে। তারপর তো সব শ্রেণির দর্শকদের মুখে মুখে এ গান। এখন একাই কোনো মঞ্চে যখন গাই আর তপনদাসহ গাই, আমাদের কাছে দর্শকের প্রথম অনুরোধ আসে এ গানটি।’