রাত দুটোর সময় দেখি, সেলফোনে রিং।
আমি সাধারণত রাত ১২টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাই, সেদিন কী কারণে জেগে ছিলাম, মনে নেই। ফোনের ওপাশে ফরীদি ভাই।
‘ঘুমাচ্ছিলে না তো!’
‘এ সময় আমি জেগে থাকি না। আপনি ফোন করবেন বলেই হয়তো জেগে আছি।’
‘চাপাবাজি কইরো না! আমি একবার ফোন দিলাম আর কি! যদি জেগে থাকো! ধরবা। না থাকলে কাল করতাম!’
‘না না, জেগে আছি ফরীদি ভাই।’
‘শোনো, এখন আমি কোন পোশাকে আছি জানো? পুরো সাদা শার্ট আর প্যান্ট। একটা চরিত্রের মধ্যে ঢুকে আছি!’
‘এত রাতে চরিত্রের মধ্যে ঢুকে আছেন!’
‘তা ছাড়া উপায় কী? আমার কি সময় আছে? সারা দিন শুটিং, সারা দিন চারপাশে লোকজন!’
‘কোন চরিত্র?’
‘আরে রাখো মিয়া! আমি ফোন করেছি কেন, সেটা শোনো আগে। পরে চরিত্র দেখা যাবে। কাল যে কথাগুলো বললাম, ঠিক ছিল তো?’
‘কেন ঠিক থাকবে না? আপনি তো বানিয়ে কিছু বলেননি!’
‘না, বানিয়ে বলিনি। কিন্তু এটা তো একধরনের মূল্যায়ন। কেউ যদি মন খারাপ করে?’
‘ফরীদি ভাই, আমার মনে যদি কোনো প্রশ্ন থাকত, তাহলে আমি তখনই আপনাকে সে বিষয়ে সতর্ক করতাম। কারও মনে কোনো প্রশ্ন জাগবে না।’
‘বোঝোই তো! কত বছরের সংসার! কত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক! ঠিকমতো গুছিয়েও তো বলতে পারলাম না!’
‘আপনার মন যদি খুঁতখুঁত করে, তাহলে আপনার অংশটা একবার পড়ে শোনাব কাল?’
কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘না, থাক! তুমি যখন বলছ সমস্যা নাই, তাহলে সমস্যা নাই। যাও, ঘুমাও।’
ফোন কেটে দিলেন তিনি। আমি বোকা হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
বিষয়টা আর কিছু নয়, ঢাকা থিয়েটারের সাতজন তারকার সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোর বিনোদন ক্রোড়পত্র ‘আনন্দে’র মূল রচনা তৈরি করছিলাম। এ জন্য প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলার পর লেখাটাও তৈরি করে ফেলেছি। ফরীদি ভাইয়ের হঠাৎ মনে হতে পারে, বন্ধুদের ব্যাপারে যা বলেছেন, তা ঠিকঠাক আছে তো? এ কারণেই রাত দুটোর সময় মোবাইল হামলা।
লেখাটা ছাপা হওয়ার পর ঢাকা থিয়েটারের প্রত্যেকেই ফোন করেছিলেন, মনে পড়ে।
ফরীদি ভাই বলেছিলেন, ‘কাউকে ডুবাইনি তাহলে?’
আমাদের সময়ের নায়কেরা
মুক্তিযুদ্ধের পর অস্থির সময় পার করছিল দেশ। আমার বয়স তখন পাঁচ।
সে সময় বঙ্গবন্ধু নিউ ইস্কাটনের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির দোতলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। বাড়িটি ছিল বিশাল। কিছুদিন পর ঢাকা থিয়েটারের কয়েকজন সদ্য যুবক আমাদের বাড়িকে বানালেন আড্ডাস্থল। এঁদের মধ্যে ছিলেন আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, সাইদুল আনাম টুটুল আর রিয়াজুদ্দীন বাদশা। আর কারা ছিলেন, সেটা আর এখন মনে নেই। বাড়ির সামনের কতবেলগাছটার নিচে ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’ নাটকের মহড়া করেছিলেন তাঁরা। ছবি তুলেছিলেন। সে ছবি অনেক দিন ছিল আমাদের কাছে। এখনো আমার কোনো ভাইয়ের কাছে থাকতে পারে।
এঁদের মধ্যে সবচেয়ে আড্ডাবাজ ছিলেন আল মনসুর। বেলাল ভাই নামেই তাঁকে ডাকতাম আমরা। শান্তিনগরের হক রেস্তোরাঁয় তাঁরা যখন আড্ডা দিতেন, তখন আমার মেজ ভাই শাহীন রেজা নূরও সেই আড্ডায় শরিক হতেন। তাঁরই আহ্বানে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল আড্ডাটা। সেই শিশু বয়সেই এঁদের মাধ্যমে ‘রেনেসাঁ’, ‘সফোক্লিস’ প্রভৃতি শব্দগুলো শোনা।
হাবিবুল হাসান, যিনি পরে ‘মাকনা ভাই’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন, তিনি নাটকের ব্যাপারে একটা কথা বলেছিলেন। নাটক হতে হবে একদম জীবনের কথা। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, সংলাপ হতে পারে এ রকম, ‘কোথায় যাস?’ ‘মুতে আসি!’
জানি না, এ রকম সংলাপ পরে যুক্ত হয়েছিল কি না কোনো নাটকে।
এই মানুষেরাই তখন ছিলেন আমাদের জীবনের নায়ক। তখনো বোধ হয় ফরীদি ভাই ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হননি। কিন্তু যুক্ত হওয়ার পর ফরীদি ভাই যখন নাটকের একটা বিশাল পথ পাড়ি দিয়েছেন, চলচ্চিত্রে গেছেন নিজেকে আর্থিক অনটন থেকে বাঁচাতে, তখন আল মনসুর একদিন আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ফরীদি ভাই সম্পর্কে উচ্চারণ করলেন এক শাণিত বাক্য, ‘এই মাটিতে জন্ম নেওয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চির উজ্জ্বল অভিনেতা হলো হুমায়ুন ফরীদি।’
আল মনসুর এ কথা বলার অনেক পরে হুমায়ুন ফরীদিকে যখন এই মূল্যায়নের কথা জানিয়েছিলাম, তখন ফরীদি ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘বেলাল ভাই, আল মনসুর তো মানুষ। একটা মানুষ সত্য কথা বলবে না? প্রাণ খুলে কথা বলবে না?’
‘প্রাণ খুলে কথা বলা মহাপাপ’
প্রাণ খুলে কথা বলা নিয়ে ফরীদি ভাইয়ের ছিল অস্বস্তি। একটা সময় এসে হাজির হলো, যখন ছদ্মাবরণটাই মানুষের পরিচয় হয়ে উঠতে লাগল। ফরীদি ভাই বরাবরই ছিলেন সোজাসাপটা কথা বলার মানুষ। তাই এ ধরনের মেকি সম্পর্কগুলো তিনি পছন্দ করতেন না।
সে কথা প্রসঙ্গেই ফরীদি ভাই বলেছিলেন, ‘তিন ধরনের শিল্পী আছে পৃথিবীতে। ভালো শিল্পী, বিপদগ্রস্ত শিল্পী, অশিল্পী। বিপদগ্রস্ত শিল্পী মনে করে, এই বুঝি আমি পড়ে গেলাম। আমি এদের সম্পর্কে বলি, পড়ে যাওয়ার কথা মনে রাখার দরকার নাই তো! চরিত্রটা ঠিকমতো করো। বেশি কাজ করার দরকার কী? মাসে ২০ দিন কাজ করলেই যথেষ্ট। আমাদের টিভি নাটকে এখন তাড়াহুড়া ঢুকে গেছে। এই তাড়াহুড়াটা বন্ধ করতে হবে। না হলে হঠাৎ করেই এরা পড়ে যাবে। একই ধরনের বৈচিত্র্যহীন অভিনয় করে যাবে। এখনকার শিল্পীরা ত্রস্ত। দৌড়াচ্ছে। এই দৌড়টা বন্ধ করে হেঁটে যাও। টাকার পেছনে না ছুটে ভালো অভিনয় করো। টাকা আপনিই আসবে। আগে শিল্পী হতে হবে তো!’
খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যাবে, এখানে তিন ধরনের শিল্পীর মধ্যে মাঝের যিনি, অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত শিল্পীর ব্যাপারেই কথা বলেছেন তিনি। প্রথম ও তৃতীয়টা নিয়ে তাঁর মনে কোনো সংশয় নেই।
সে সময়েই নিঃসংশয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ভালো মাপের নাটক কম হচ্ছে। অধিকাংশ নাটকই খারাপ। নাটকের নামই তো পছন্দ হচ্ছে না। কী সব সিরিয়াল তৈরি হচ্ছে, অদ্ভুত তাদের নাম। যেটার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের বা শিল্পের কোনো সম্পর্ক নাই। বিচ্ছিরি সব নাম।’
চরিত্রের প্রতি ভালোবাসার কথা বলেছেন তিনি। তাঁর একটা ঘটনার কথা বলি এখানে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় একটি নাটক হবে। তাতে মূল চরিত্রে তিনি নির্বাচন করলেন ফরীদিকে। ফরীদি স্রেফ বলে দিলেন, মূল চরিত্রে তিনি অভিনয় করবেন না। করবেন, এক দৃশ্যে থাকা এক বিপ্লবী ছেলের চরিত্রে! প্রযোজক সেটাতেই রাজি হতে বাধ্য হলেন। অডিশনের ব্যাপার থাকে। ফরীদি সে পথ মাড়ালেন না। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকে ফরীদিই সম্ভবত প্রথম অডিশন ছাড়া শিল্পী।
আল্লাহর কসম গেইটলক
আফজাল হোসেন একটা দারুণ কথা বলেছিলেন একবার। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘মঞ্চে যুক্ত হওয়াটা অসাধারণ ঘটনা। আমরা সিরিয়াসলি থিয়েটার করতাম। “সিরিয়াসলি” কথাটা বলার কারণ আছে। এখন বাসের গায়ে লেখা দেখি, “আল্লাহর কসম গেইক লক”। একটা সময় গেইট লক বললেই চলত। এখন কেউ আর তা বিশ্বাস করে না। আমরা যখন কাজ করতাম, তখন “সিরিয়াসলি” কথাটা যুক্ত করার দরকার ছিল না। এখন মনে হয়, সেটা করতে হবে।’
ফরীদির কথা বলতে গিয়ে তাঁরই ঢাকা থিয়েটারের সতীর্থ আফজাল হোসেনের এই আপাত-অপ্রাসঙ্গিক কথাটা তুলে আনা কেন?
কারণ আর কিছুই নয়, হুমায়ুন ফরীদি কখনোই অভিনয়টাকে ছেলেখেলা হিসেবে দেখেননি। তিনি কখনোই বিপদগ্রস্ত শিল্পী হতে চাননি। তিনি জানতেন, জীবনে অভিনয় ছাড়া আর কিছুই তিনি শেখেননি। তাই তিনি নিজের অর্জন বলতে বুঝতেন, প্রতিনিয়ত অভিনয় করতে করতে নতুন নতুন চরিত্র আবিষ্কার করা, মানুষের ভালোবাসা পাওয়াকেই।
ফরীদি ভাই সব সময় আনন্দে থাকতে চাইতেন। পারতেনও। তিনি বুঝতেন, সারাক্ষণ তো কেউ আনন্দে থাকতে পারে না, কিন্তু সে চেষ্টাটা করে যেতে হয়। তিনি বলেছিলেন একটা খাঁটি কথা, ‘অধিকাংশ সময় আনন্দে থাকতে চাই। আনন্দে ছিলাম, আনন্দে আছি, আনন্দে থাকব। কারণ আমার তেমন চাহিদা নেই। যার লোভ আছে, তার আনন্দ নেই।’
৬০ বছর বরণ করে নেওয়ার পর যেদিন ধানমন্ডিতে ফরীদি ভাইয়ের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সেদিন বিকেলে তিনি ছিলেন একা। বসার ঘরে আসবাব প্রায় কিছুই ছিল না। তবে মনে আছে, দেয়ালে টাঙানো ছিল শিল্পী সুলতানের আঁকা পেশিবহুল এক মানুষের ছবি। এ নিয়ে যখন লিখেছিলাম, তখন বলেছিলাম, সে ছবিতে ছিল পরিশ্রম আর মেধার যুগলবন্দী।
আজ হুমায়ুন ফরীদিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে সে কথাটাই লিখতে হচ্ছে, তবে সুলতানের ছবিটি নিয়ে নয়, ফরীদিকে নিয়ে। ফরীদি সত্যিই ছিলেন পরিশ্রম আর মেধার যুগলবন্দী।
ডিভিডিগুলো
যেদিন শেষ দেখা, সেদিন কয়েকটি ডিভিডি উপহার দেব বলে কথা দিয়েছিলাম তাঁকে। কিনেছিলাম আজিজ সুপার মার্কেট থেকে। ইচ্ছে ছিল তাঁর হাতে পৌঁছে দেব। সে সময় বন্ধুদের নিয়ে রাতে সিনেমা দেখতেন তিনি।
একদিন অফিস থেকে সুমি আপার ফোন পেলাম। মারা গেছেন হুমায়ুন ফরীদি। সে অবস্থায়ই গাড়ি চালিয়ে ফরীদি ভাইয়ের বাড়িতে গেলাম।
গাড়িতে ছিল সেই ডিভিডিগুলো। কিন্তু সেদিন আর তাঁর বাড়িতে গিয়ে লিফটের তিনে উঠে তাঁর হাতে ডিভিডিগুলো দেওয়া হলো না। বাড়ির নিচেই একটা জায়গা ঘিরে তাঁকে শেষ গোসল করানো হচ্ছে তখন। একে একে সংস্কৃতিজগতের লোকেরা আসা শুরু করেছেন।
তখন আমি সাংবাদিক। ডায়েরিতে নোট নিচ্ছি। কে কী বলছেন, তা টুকে নেওয়া হচ্ছে। সবকিছুই ফরীদিময়। শুধু ফরীদি ভাইই নেই।
জন্মদিনের লেখাটি মৃত্যুদিনের আবহ দিয়ে শেষ করতে চাই না। হুমায়ুন ফরীদির কথা ভাবতে গেলে অপার বিস্ময় নিয়ে ভাবতে হয়, তিনি আমাদের পারফরম্যান্স আর্ট থেকে প্রচলিত নায়কের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন। খলনায়ককেও প্রধান চরিত্র ভাবতে বাধ্য করেছেন। সেলিম আল দীনের লেখা টিভি নাটক ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’র খলনায়ক সেরাজ তালুকদারের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সে কালের মানুষদের? অভিনয়টাকে জীবন করে নিয়েছিলেন বলেই তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো জীবন পেত। সেটাই ছিল আমাদের প্রাপ্তি।
একটা মোবাইল ফোনবিহীন জীবন চেয়েছিলেন তিনি। যেখানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থাকবে, আবার যোগাযোগ হয়ে গেলে মন ভরে উঠবে আমোদে।
এখন তিনি মোবাইল ফোনবিহীন। তবে, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের উপায় নেই বলে আমরা ওই অনিশ্চয়তাটুকু ভরে দিতে চাই তাঁর করা নাটকগুলোর কথা মনে করে।
হুমায়ুন ফরীদি আসলে একজনই।